সুরমার ঢেউ সংবাদ :: সিলেটে হত্যামামলার আসামী ‘কালা ইমন’ এর স্থলে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ ৭ মাস ধরে জেল খাটছেন কলেজছাত্র ইমন আহমদ। তিনি নগরীর কুয়ারপাড় এলাকার মৃতঃ ময়না মিয়ার পুত্র ও তিনি সিলেট সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের উড ওয়ার্কিং বিভাগের ২য় সেমিস্টারের ছাত্র। বিষয়টি জেনেও মামলার এজাহারে তার নাম অর্ন্তভুক্ত করা হয়। স্বজনদের পাশাপাশি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়া এক আসামিও বলেছেন, ঘটনার সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন ‘কালা ইমন’ নামের আরেক তরুণ। এদিকে মামলার বাদী বলেছেন, তিনি এখন একটু বেকায়দায় আছেন। তা না হলে আদালতে গিয়ে বলতেন, কলেজছাত্র ইমন আসামি নন।
পুলিশ, এজাহার ও স্বজনদের সূত্রে জানা গেছে- গত ৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিলেট নগরের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকের সামনে হোটেলশ্রমিক নাজিম উদ্দিনকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওইসময় আহত হন শাহ আলম ও রুম্মান। তাঁরা নগরের জালালাবাদ এলাকার বাসিন্দা ও নিহত নাজিমের আত্মীয়। ঘটনার রাতেই সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানায় ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহত নাজিমের পিতাা নুর মিয়া। আসামিরা হলেন- নগরীর মুন্সিপাড়ার সবুজ মাঠ এলাকার জুয়েল আহমদ, মুন্সিপাড়ার রুমেল আহমদ, সুবিদবাজার বনকলাপাড়ার সোহাগ, মোজাম্মেল, মুন্সিপাড়ার ইমন ও জনি এবং কুয়ারপাড়ের ইমন, একই এলাকার সামি, বাগবাড়ি এলাকার কবির ও সুবিদবাজার বনকলাপাড়ার রফিকুল।
নাজিম খুন হবার সময় জনতা ঘটনাস্থল থেকে জুয়েল আহমদকে আটক করে পুলিশে দেয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের নাম বলেন জুয়েল। এর মধ্যে নগরের মুন্সিপাড়ার মামুন মিয়ার পুত্র ‘কালা ইমন’ ছিলেন।
নিহত নাজিমের এক আত্মীয় জানান- নাজিমের পিতা নুর মিয়া থানায় মামলা করতে যাবার সময় তিনিও সঙ্গে ছিলেন। কুয়ারপাড়ের ইমনকে তিনি আগে থেকেই চিনেন। ঘটনায় এই ছাত্র জড়িত নন দাবি করলে থানা-হেফাজতে থাকা জুয়েলকে ডাকা হয়। কুয়ারপাড়ের ইমনের ছবি দেখানো হলে জুয়েল জানান- ছবির এই তরুণকে তিনি চেনেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাজিমের ওই আত্মীয় আরও বলেন- জুয়েল ১৩ এপ্রিল সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল মোমেনের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তাদের সঙ্গে ছিলেন ‘কালা ইমন’। এদিকে এর আগে ১১ এপ্রিল র্যাব-৯-এর একটি টিম সোহাগ ও সানিকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানায় হস্তান্তর করে। সোহাগ ও সানি আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে শুধু ইমন বলেছেন। ১৪ এপ্রিল কলেজছাত্র ইমনকে গ্রেপ্তার করে থানায় হস্তান্তর করে র্যাব। পরে তাকে ২ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ড শেষে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
জানতে চাইলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়া জুয়েলের মা পারভীন বেগম বলেন- কারাগারে থাকা ইমনকে জুয়েল চেনেন না বলে তাঁকেও জানিয়েছেন। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন- ‘আইন অনুযায়ী আমাদের কিছুই করার নেই। তবু জজ স্যার বা ঊর্ধ্বতন কেউ কারা পরিদর্শনে এলে ইমনের বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করব।’
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করে জানতে চাইলে ইমন বলেন, ঘটনার দিন ইফতারের পর তার হবু শ্বশুরবাড়ি সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বলাউড়া এলাকার কসকালিকা গ্রামে যান। রাত ১০টার দিকে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। অথচ এজাহারে বলা হয়েছে, খুনের ওই ঘটনা ঘটে রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে। ঘটনার সময় হামলাকারীদের আঘাতে আহত হন শাহ আলম ও রুম্মান। তারাও কলেজছাত্র ইমনকে ঘটনাস্থলে দেখেননি বলে জানিয়েছেন।
ইমনের হবু শ্বশুর জেবুল আহমদ বলেন, ‘ইফতারের পর ইমন আমাদের বাড়ি আসে। রাত ১০টার পর সে চলে যায়। রমজানের পর আমার মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের কথা ছিল। এখন সে যদি ঘটনার সময় অন্য কোথাও থাকত, আর মামলা হইত, তাহলে মনকে বোঝানো যাইত। নিজের চোখের সামনে থেকে গিয়ে ছেলেটা বিনা দোষে কত বড় বিপদে পড়ল।’
মামলার বাদী নিহত নাজিম উদ্দিনের বাবা নুর মিয়া বলেন- হয়তো তার কোনো শত্রু কুয়ারপাড়ের ইমনের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন বিষয়টি আদালতে বললে মামলার ক্ষতি হবে, এজন্য তিনি বলবেন না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- ‘কিছু মানুষের জন্য এখন একটু বেকায়দায় আছি। নাহলে আমরা আদালতে গিয়ে বলতাম, কুয়ারপাড়ের ইমন আসামি না। আর, আমরা কোনো আসামির নাম দেই নাই। গ্রেপ্তার আসামি যাদের নাম বলেছে, তাদেরই আসামি করা হয়েছে।’
ইমনের ভাই রোমন আহমদ রুনু বলেন, ‘আমার ভাই যে নির্দোষ, তা তদন্ত কর্মকর্তা এসআই এ এইচ এম রাশেদ ফজল জানেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, রাঘববোয়ালদের সাথে লাগে কেন তোমার ভাই ?’ ইমনের আইনজীবী টিপু রঞ্জন দাশ বলেন, ‘এজাহারের ভাষ্যমতে তার কোনো অপরাধ নেই। ভিকটিমকে কোনো কিছু করার অভিযোগও নেই। ৩ জন আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে, তাদের ২ জন শুধু ইমন বলেছে। ১ জন স্পষ্টকরে কালা ইমন বলেছে। এজাহারে ২ জন ইমন আছে। আমাদের কাছে সব ধরনের ডকুমেন্ট আছে, এ ঘটনার সাথে কুয়ারপাড়ের ইমনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমরা আদালতকে সেটি বলেছি।’
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও কোতোয়ালি থানার লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই এ এইচ এম রাশেদ ফজল বলেন, ‘এসব বিষয়ে ওসি বা এসএমপির মিডিয়া কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি অনুমতি ছাড়া কিছুই বলতে পারব না।’
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী মাহমুদ বলেন, ‘বাদীর দেয়া এজাহারেই মামলা রেকর্ড হয়েছে। নির্দোষ কেউ হত্যা মামলার আসামি হোক, সেটা আমরাও চাই না। তদন্ত কর্মকর্তাকে ডেকে ওই আসামির বিষয়টি পুনরায় গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখতে বলব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাদী জানলে তিনি আদালতকে বলতে পারেন।’ চাইলে মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি নওশাদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। কোর্টে গিয়ে নথিপত্র দেখে বলতে হবে।’