ইশরাত জাহান চৌধুরী :: মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় নারী চা শ্রমিকদের ছবি তোলা নিয়ে ঢাকা উত্তর মহানগর ছাত্রলীগ পর্যটকদের সাথে চা শ্রমিকদের সংঘর্ষে ইস্পাহানী জেরিন চা বাগানের ডেপুটি ম্যানেজারসহ ১৬ জন আহত হয়েছেন। এসময় গ্রান্ড মোবিন রিসোর্ট নামে একটি গেষ্ট হাউসের দরজা জানালা ও আসবাবপত্র ভাংচুর হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাধানগর এলাকার গ্রান্ড মোবিন রিসোর্টেও অবস্থানকারী ঢাকা উত্তর মহানগর ছাত্রলীগ পর্যটক ইব্রাহিম হোসেন, আবিদ হোসেন, মামুন মিয়া, মেহেদী হাসান, রাজ্জাক মিয়া, আনোয়ার হোসেনসহ ২২ জন অতিথি পাশ্ববর্তী ইস্পাহানি চা কোম্পানীর জেরিন বাগানে প্রবেশ করে চা পাতা চয়নরত নারী শ্রমিকদের ছবি তুলেন। এসময় নারী চা শ্রমিকরা বিনা অনুমতিতে কাটাতারের বেড়া পেড়িয়ে চা বাগানে প্রবেশ ও অপ্রস্তুত অবস্থায় তাদের ছবি তুলতে নিষেধ করেন। কিন্তু, বাধা উপেক্ষা করে পর্যটকরা আবারও ছবি তোলার চেষ্টা করলে নারী শ্রমিকরা বাগানের সাহেব ও বাবুদের খবর দেন।
খবর পেয়ে বাগানের ডেপুটি ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী এসে পর্যটকদের বাগান থেকে বেড়িয়ে যাবার জন্য বলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ঢাকা উত্তর মহানগর ছাত্রলীগ পর্যটকরা মোহাম্মদ আলীকে টেনে হিচরে রিসোর্টের ভেতর নিয়ে যান। এসময় শ্রমিকরা ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে এবং বিপদে প্রথা অনুযায়ী বাগানের ‘পাগলা ঘন্টা’ বাজানো হলে বাগানজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এসময় কয়েকশ’ চা শ্রমিক তাদের ম্যানেজারকে উদ্ধারে মোবিন রিসোর্টে হামলা চালিয়ে দরজা জানালা ও আসবাবপত্র ভাংচুর করেন। এসময় উত্তেজিত চা শ্রমিকদের সাথে পর্যটকদের সংর্ঘষ বাঁধে। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের ১৫ জন আহত হয়েছেন। আহতরা হলেন জেরিন চা বাগানের ডেপুটি ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী (৪৫), শ্রমিক মামুন মিয়া (২৪), অঞ্জলী ব্যক্তি (২৫), ছন্দা সবর (৩৫), বিশ্বমনী রিকিয়াশন (২৬), পারুল বেগম (৩০), ভারতী সাওতাল (৪০), অনিতা গোয়ালা (৪০), আলো মনি বাড়ই (২৫) সুতি সাংমা (৪০), মুসলিম মিয়া (২০), উত্তম গড়াই (২৫), আব্দুল কাদির (২৬), ইন্দ্রজিত দাস (২৫) ঢাকা থেকে আসা ছাত্রলীগ নেতা মো. রাফি (২৯) ও মো. রাসেল মিয়া (২৭)। আহতদেরকে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বাগান হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
খবর পেয়ে শ্রীমঙ্গল থানার ওসি আব্দুছ ছালেক, ওসি (অপারেশন) নয়ন কারকুন, ওসি (তদন্ত) হুমায়ন কবিরসহ একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনেন।
পুলিশ পর্যটকদের নিরাপত্তা জন্য রিসোর্ট থেকে বাইরে এনে শ্রীমঙ্গল শহরের দিকে পাঠিয়ে দেয়। এছাড়া জেরিন চা বাগানের জেনালের ম্যানেজার সেলিম রেজা, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রেম সাগর হাজরা, স্থানীয় ইউপি মেম্বার বিশ্বজিৎ দেব বর্ম্মা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
গ্রান্ড মোবিন রিসোর্টের পরিচালক ইসরাত জাহান মিতু বলেন- ‘বুধবার ঢাকা থেকে ছাত্রলীগের পরিচয়ে ২২ জন অতিথি তাদের রিসোর্ট ভাড়া নেন। রাতে তারা বারবি কিউ পার্টি করের। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে তাদের চেক আউট করার কথা ছিল। এরই মধ্যে ছবি তোলা নিয়ে চা শ্রমিকরা হামলা করে। এসময় ৭শ’ থেকে ৮শ’ শ্রমিক আমার রিসোর্টে নির্বিচারে হামলা চালিয়ে দরজা জানালা ও আসবাবপত্র ভাংচুর করে। এতে করে আমাদের ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
শ্রমিকদের হামলায় আমাদের দুই অতিথি আহত হয়েছেন। মিতু বলেন- ‘অতিথিরা সাড়ে ১৬ হাজার টাকা ভাড়া ও প্রায় ১৪ হাজার ৬শ’ ৪০ টাকার খাবারের বিল বকেয়া রেখে চলে যান। এ টাকা পাবো কি না তারও কোন নিশ্চয়তা নেই’।
জেরিন চা বাগানের জেনালের ম্যানেজার সেলিম রেজা বলেন, ‘বেলা ১১টার দিকে তাদের চা বাগানের পাশে একটি রিসোর্টের ২০-২২ জন যুবক বিনা অনুমতিতে বাগানে প্রবেশ করে চা পাতা চয়নরত ‘অপ্রস্তুত’ চা নারী শ্রমিকদের ছবি তুলে। বাধা দিলে তারা নারী শ্রমিকদের লাঞ্ছিত করে। পরে আমাদের একজন ম্যানেজারকে সার্টের কলার ধরে রিসোর্টে নিয়ে যায়। এ খবর বাগানে ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে তাদের ম্যানেজারকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। সেখানে কিছু গন্ডগোল হয়েছে জানিয়ে সেলিম রেজা বলেন, যা হবার হয়েছে, এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করতে চাই না’। এ বিষয়ে চেষ্টা করেও কোন পর্যটকের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন তাদের (ছাত্রলীগ নেতাদের) উপর হামলার কথা অস্বীকার করে বলেন, চা বাগানে ছবি তুলা নিয়ে স্থানীয় চা শ্রমিকদের সাথে একটু কথা-কাটাকাটি হয়েছিলো। পরে স্থানীয়রা এসে এটির একটি সমাধান করে দিয়েছেন। শ্রীমঙ্গল থানার ওসি (অপারেশন) নয়ন কারকুন বলেন, ‘ছবি তোলা নিয়ে সংঘর্রে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনি। পরে পর্যটকদের বের করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়। এছাড়া বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের বিচারের আশ্বাস দিয়ে তাদের নিবৃত করা হয়েছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক’ জানান ওসি (অপারেশন) নয়ন কারকুন। মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে উক্ত ঘটনায় থানায় কোন অভিযোগ দায়ের হয়নি।