পাঠদান বন্ধের উপক্রম সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ১৮ বিদ্যালয়ে

পাঠদান বন্ধের উপক্রম সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ১৮ বিদ্যালয়ে

সুরমার ঢেউ সংবাদ :: সুনামগঞ্জের দুর্গম হাওরাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধের উপক্রম হয়েছে। পদায়ন ও বদলিতে অনিয়মের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। জেলার ১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে ১ জন করে শিক্ষক দিয়ে। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনো কাজে বাইরে থাকলে পাঠদান চলে প্রেষণ বা প্যারা শিক্ষক দিয়ে।
জামালগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩০ জন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক সূর্য চক্রবর্তী বৃহস্পতিবার উপজেলা সদরে ‘এসো শিখি’র ট্রেনিংয়ে ছিলেন। এ বিদ্যালয়ে অন্য আরেকটি বিদ্যালয়ের ১ জন শিক্ষককে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হলেও তিনি যোগদানই করেননি। বৃহস্পতিবার বিষ্ণু চক্রবর্তী জানান- তিনি ট্রেনিংয়ে রয়েছেন। এলাকার এক যুবককে প্যারা শিক্ষক হিসেবে পাঠদানের দায়িত্ব দিয়ে এসেছেন। তাহিরপুর উপজেলার মন্দিহাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সানজু মিয়া উপজেলা সমন্বয় সভায় যাওয়ায় বুধবার ওই বিদ্যালয়ে পাঠদানই বন্ধ ছিল।
কাল্লা উপজেলার বড়গাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রাজনের মা ইলা রানী সরকার জানান, তাঁর ছেলে বৃহস্পতিবার বিদ্যালয়ে যায়নি। প্রায়ই ক্লাস হয় না। এতে শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগ্রহ হারাচ্ছে। নিয়মিত শিক্ষক উপস্থিত না থাকায় তারাও বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে যেতে জোর করেন না। শাল্লার আব্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক ও স্থানীয় ইউপি মেম্বার নিখিল চন্দ্র দাস জানান- বাচ্চাদের পড়ালেখা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষক না থাকায় তারা বিদ্যালয়ে গিয়ে কিছু সময় হই হুল্লোড় করে বাড়ি ফিরে আসে। গত এক বছর ধরে এমন পরিস্থিতি চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়- জামালগঞ্জের বিষ্ণুপুর, তাহিরপুরের মন্দিহাতা, শাল্লার বড়গাঁও, আব্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ জেলার ১৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একই অবস্থা। অন্য বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে– তাহিরপুরের শরিফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জামালগঞ্জের নিধিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ধর্মপাশার দরাপপুর, পাথারিয়া কান্দা ও দক্ষিণ আমজোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাল্লার নিজগাঁও ও শ্রীহাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দিরাই উপজেলার আলীপুর, রতনগঞ্জ, তারাপাড়া ও কুলঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ ছাড়া জামালগঞ্জের আমানিপুর, দিরাইয়ের মিঠাপুর ও শান্তিগঞ্জের উমেদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকই নেই। প্রেষণে দুই-একজন শিক্ষক দিয়ে কোনোরকমে খোলা রাখা হয়েছে সেগুলো।
শাল্লার শ্রীহাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান ব্যাহত হওয়ায় এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেন রাজনীতিবিদ আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদ চৌধুরী (আল আমিন চৌধুরী)। আপাতত তার আর্থিক সহায়তায় নিয়োগ করা একজন প্যারা শিক্ষক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে পাঠদান চলমান। তিনি জানান- নিয়োগ এবং বদলির অনিয়মে হাওরাঞ্চলের দুর্গম এলাকার বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হবার পথে। পদায়ন হবে শূন্যপদ সাপেক্ষে। তবে, প্রাথমিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষ নানা ফন্দি-ফিকির করে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যেখানে প্রয়োজন কম, সেখানে পদায়ন দিচ্ছে। দুর্গম এলাকার শিশুরা শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বানও জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জানান- প্রত্যন্ত এলাকার একজন শিক্ষকের বিদ্যালয়ে প্রেষণে অন্য স্কুলের শিক্ষক দেয়ার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের সঙ্গে কথা না বলেই সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। এতে এসব শিক্ষক বেশির ভাগ দিনই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকেন। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
জেলার তাহিরপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার লিটন জানান- বিগত সময়ে শিক্ষক পদায়নের ক্ষেত্রে ত্রুটি হয়েছে, যেখানে শিক্ষক না দিলেও চলে সেখানে পদায়ন দেয়া হয়েছে। যেখানে পদায়ন জরুরি, সেখানে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। চাইলেই এসব সমস্যার সমাধান করতে পারে কর্তৃপক্ষ।
টিআইবির সচেতন নাগরিক কমিটির সহ-সভাপতি খলিল রহমান জানান- পদায়নের ক্ষেত্রে দুর্গম অঞ্চল যেমন বঞ্চিত হয়, নিরীহরাও বঞ্চনার শিকার হয়। প্রভাবশালীদের তদবিরে কিংবা আর্থিক সুবিধা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষ অনেক শিক্ষককেই সুবিধাজনক স্থানে পদায়ন দেন। সুবিধাজনক স্থানে থেকে কেউ আয়েশে চাকরি করেন আবার কেউ দুর্গম অঞ্চলেই জীবন শেষ করছেন। এটা মেনে নেয়া যায় না।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহল লাল দাস জানান- জেলার প্রত্যন্ত এলাকার অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে পাঠদান বন্ধ হবার পথে। যে কোনোভাবে এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদায়ন করতে হবে। চলমান নিয়োগের পদায়নের সময় কোনো তদবির আমলে নেয়া হবেনা। কোনো তদবির বা প্রভাবে এ অঞ্চলের শিশুদের শিক্ষার অধিকার নষ্ট হবার সুযোগ দেয়া হবেনা। বরং এমন কিছু নিয়োগ ও পদায়নের অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *