জিয়াউল হকের মতো মানুষের ভালোবাসায় ভরে উঠুক এ দেশ, এ পৃথিবী

জিয়াউল হকের মতো মানুষের ভালোবাসায় ভরে উঠুক এ দেশ, এ পৃথিবী

শ. ই. সরকার জবলু  :: ফেরি করে করে দই বিক্রি করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিয়াউল হক। সংসার চালানোর পর বাড়তি টাকা থাকলে তা দিয়ে বই কিনে গরিব ছাত্রদের মধ্যে বিলি করেন। তাঁর দেয়া বই ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে অনেকেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি করছেন। দই বিক্রির টাকায় তিনি বাড়িতে একটা লাইব্রেরী গড়ে তুলেছেন যেখানে ১৪ হাজার বই আছে। এ ছাড়াও তিনি গরিব অসহায় নারীদের অনেককে বাড়ি করে দিয়েছেন। গ্রামে গ্রামে নলকূপ বসিয়ে দিয়েছেন। অসহায় মানুষদের খাদ্য ও বস্ত্র দিয়েও সহায়তা করে আসছেন অনেক বছর থেকে।
সাধারণের মতো দেখতে অসাধারণ এ মানুষটা এবার সমাজসেবায় একুশে পদক পেয়েছেন। মানুষজন তাকে শুভেচ্ছা জানাতে বাড়িতে গিয়ে দেখেন, জীবিকার তাগিদে তখন দই বিক্রি করতে বেরিয়েছেন ৯০ বছর বয়স্ক জিয়াউল হক ! কারণ বাড়িতে চাল কেনার টাকা নেই।
কী অসাধারণ মানবজীবন ! আজকাল রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়া অনেক মানুষের নাম আর অনেককে বিস্মিত বা বিমোহিত করেনা। কিন্তু, জিয়াউল হকের পুরস্কার এবং জীবনী জেনে অনেকে বিমোহিত ! মনে হচ্ছে অন্ততঃ একজন সত্যিকারের মানুষ একুশে পদকটা পেয়েছেন। আমাদের পাঠ্যবইয়ে বিখ্যাত মানুষের জীবনীর সাথে এইসব মহৎ প্রাণ মানুষের গল্পগুলো থাকা উচিত- যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মানবিক হতে শেখে ।
জিয়াউল হক চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার মুসরিভূজা বটতলা গ্রামের বাসিন্দা। প্রথম আলো লিখেছে, পুরস্কার পাবার খবরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শুভাকাঙ্খীদের ভিড়। কিন্তু, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রহনপুর স্টেশন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, তিনি একটি ওষুধের দোকানের সামনে বসে দই বিক্রিতে ব্যস্ত। কারণ, ভীষণ যত্ন করে বানানো তাঁর দই আশেপাশের সবাই পছন্দ করেন। আর সেই দই বিক্রির টাকায় চলে তাঁর জীবন। চলে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজ।
জিয়াউল হক জানান- ১৯৫৫ সালে তিনি ৫ম শ্রেণি পাস করে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে চান। কিন্তু বাড়ি বাড়ি গরুর দুধ দোহন করে জীবিকা নির্বাহ করা বাবা বই কেনার জন্য দেড় টাকা দিতে পারেননি। উচ্চ বিদ্যালয়েও ভর্তি হওয়া হয়ে ওঠেনি আর। এরপর বাবার সংগ্রহ করা দুধ দিয়ে দই তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি করা শুরু করেন। দু’তিন বছর পর কিছু টাকা জমলে ভাবেন যারা তাঁর মতো টাকার অভাবে বই কিনতে না পেরে লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়তে পারে, তাদের তিনি এ টাকা দিয়ে বই কিনে দেবেন। তবেই তাঁর বিদ্যালয়ে পড়তে না পারার বেদনা লাঘব হবে।
এরপর থেকে গরিব ছাত্রদের মধ্যে বই বিলি শুরু করেন। যতদিন পর্যন্ত সরকার বই বিনামূল্যে দেয়া শুরু করেনি, ততদিন পর্যন্ত তিনি বই দিয়েছেন। আর সরকার বিনামূল্যে স্কুলে বই দেয়া শুরু করলে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণির ছাত্রদের বই দিতে থাকেন জিয়াউল। তাঁর দেয়া বই পড়ে ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে অনেকেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি করছেন। শুধু তাই নয়, দই বিক্রি করা টাকায় যে লাইব্রেরী করেছেন তাতে এখন ১৪ হাজার বই আছে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বইও আছে পাঠাগারে। কারণ জিয়াউল হক মনে করেন শুধু পাঠ্যবই পড়ে ছাত্রদের জ্ঞান অর্জন হবেনা।
কী অসাধারণ মানবজীবন ! আরেকজন মানুষের জন্য যিনি ভাবতে পারেন, তাদের জন্য করতে পারেন, তিনিই সত্যিকারের মানুষ। জিয়াউল হক তেমনি একজন মানুষ। জিয়াউল হকের মতো মানুষের ভালোবাসায় ভরে উঠুক এ দেশ, এ পৃথিবী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *