সুরমার ঢেউ জাতীয় :: বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আরেফিন সিদ্দিক ভবিষ্যতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের মতো ষড়যন্ত্র ঠেকাতে, সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রটির নেপথ্যে কারা ছিল- তা উদঘাটনে বিষদ গবেষণা ও তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ৪৭তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষ্যে শোকের মাসের ওপর এক সাক্ষাৎকার প্রদানকালে তিনি বাসস-কে বলেন- ‘(১৫আগস্টের) গোটা ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উদঘাটনে একটি সত্য অনুসন্ধানী কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি।’ আরেফিন বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যার ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল, তা উদঘাটন করতে বাংলাদেশ অনেকাংশেই এযাবত প্রকাশিত বিদেশী গোপন তথ্যের ওপরেই নির্ভর করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সিদ্দিক বলেন, ‘এখন আমাদের এ ষড়যন্ত্রের আদ্যপন্ত উদঘাটনে স্থানীয় সূত্র অনুসন্ধানের পাশাপাশি, এ পর্যন্ত এই হত্যাকান্ড সম্পর্কে প্রাপ্ত বিদেশী তথ্য যাচাই ও একত্র করে হত্যাযজ্ঞের উপাখ্যান উদঘাটন করতে হবে। ’তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রটি কয়েকটি ধাপে দীর্ঘদিন ধরে করা হয় এবং ‘যদি আমরা প্রতিটি ধাপের দিকে আলোকপাত করি, তবে সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রটি সম্পর্কে জানতে পারব যে- কিভাবে একটি ঘটনার সঙ্গে আরেকটি ঘটনা সম্পর্কযুক্ত।’
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান সিদ্দিকি বলেন, এ ষড়যন্ত্রের কয়েকজন নেপথ্য নায়ক বিদেশের মাটিতে বসে পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যোগ দিয়ে থাকতে পারে এবং অন্যেরা পর্দার আড়াল থেকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ঘাতক পাঠিয়ে থাকতে পারে। এ ষড়যন্ত্রের সাথে আমেরিকার সিআইএ-ও জড়িত থাকতে পারে। তিনি বলেন, ‘ইতিহাসের স্বাথের্ই তাদের মুখোশ উন্মোচন করা উচিত।’ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এর আগে বলেছিলেন, সরকার এই হত্যা-ষড়যন্ত্রের নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য একটি কমিশন গঠনে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে অংশ গ্রহণকারী আনিসুল হক বলেন, কমিশন এই ষড়যন্ত্র উদঘাটনে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে, তাই এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান হবে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদও ৪৭ বছর আগে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সাথে শাহদাৎ বরণ করা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের হোতাদের মুখোশ উন্মোচন করতে একটি কমিশন গঠন করার জন্য কয়েকবার প্রস্তাব পেশ করেছেন। তিনি বলেন- তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, ১৫ আগস্ট হত্যা-ষড়যন্ত্রের হোতাদের মুখোশ উন্মোচন করে তাদের বিচারের সম্মুখীন করা অত্যন্ত জরুরি। হাছান মনে করেন যে, দেশবাসীও এই ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনে একটি কমিশন চায়। এ কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে প্রফেসর সিদ্দিক যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উদাহরণ দেন। ওই দেশগুলোতে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, মাহাত্মা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী হত্যার পর, এ ধরনের সত্য উদঘাটন মিশন শুরু করা হয়েছিল। তাই তিনি এই কমিশন গঠনের জন্য পুনঃআহ্বান জানান। বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন কেনেডি হত্যাকাণ্ডের সাত দিনের মধ্যে ১৯৬৩ সালের ২৯ নভেম্বর একটি কমিশন গঠন করেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে এই কমিশন ওয়ারেন কমিশন হিসেবে পরিচিত। কেনেডি ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর নিহত হন।
গণমাধ্যম যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ সিদ্দিক বলেন, ওয়ারেন কমিশন সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই তার প্রতিবেদন পেশ করে। পরে প্রতিবেদনটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এবং এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে কি ঘটেছিল, তা বিশ্ববাসীকে জানতে দেয়ার জন্য এটি পাঠাগারে রাখা হয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড কোন এক ব্যক্তি বা কোন পরিবারের হত্যাকাণ্ড নয়। এ ঘটনাটি সংঘটিত হবার মানে দেশের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধসে পড়েছিল। প্রফেসর সিদ্দিক বলেন- রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করে। কিন্তু, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনের গোটা নীলনক্সার কাজ শুরু হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অনেক আগে এবং হত্যাকাণ্ডের পরও দীর্ঘদিন ষড়যন্ত্র অব্যহত থাকে। একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে অবশ্যই এই হত্যা-রহস্য উন্মোচন করতে হবে। ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু-কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সিদ্দিক বলেন, এখনও ষড়যন্ত্র অব্যহত রয়েছে। তাই আগামী দিনগুলোতে এ ধরনের ষড়যন্ত্র ঠেকানোর জন্য এখন ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা ও সম্পূর্ণ দৃশ্যপট প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি।
সিদ্দিক বলেন, ‘ইতোমধ্যেই দুষ্কৃতকারীদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে, তাই কমিশন নতুন করে কাউকে শান্তি দেবে না। কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য হলো- ঐতিহাসিক নথি সংগ্রহ করা এবং প্রজাতন্ত্রের মালিক হিসেবে, কারা জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল, তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।’ তিনি বলেন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, আমলা, সামরিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে প্রস্তাবিত কমিগন গঠিত হতে পারে। আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল- তাদের চিহ্নিত ও বিচার করা সহজ, কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যের হোতাদেরও অবশ্যই উন্মোচন করা উচিৎ।’
ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল এর আগে বাসস’র সাথে আলাপকালে বলেছিলেন, ফৌজদারি মামলা একটি চলমান প্রক্রিয়া। কারণ, এটি সব ক্ষেত্রে শেষ হয়না। তিনি বলেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যার তদন্তের কাজ এখনও চলছে। তিনি বলেন, ‘নিয়মিত অনুষ্ঠানে আমরা মহাত্মা গান্ধী হত্যার তদন্তের কথা শুনি। তাই, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের অপরাধীদের চিহ্নিত করতে কমিশন গঠনে কোনো আইনি বা সাংবিধানিক বাঁধা নেই।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। তারা আমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করেছে। এটা একটি বিরাট ব্যাপার। যারা পর্দার অন্তরালে থেকে পুরো ঘটনাটি চালিয়েছে তাদের সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।’