শ. ই. সরকার জবলু :: মৌলভীবাজার শহরতলীর ঘড়ুয়া গ্রামে এজমালী ভূমি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার-কে দান করার অভিযোগ উঠেছে কানাডা প্রবাসী এক শরিকান ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশের বিরুদ্ধে। বেআইনী এ দানের মাধ্যমে তিনি বিতর্কিত করেছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের মতো জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে। এজমালী ভূমি বেআইনী দানের এ ঘটনায় আদালতে মামলা দায়ের করেছেন সংক্ষুব্ধ অপর শরিকান ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশের মৃতঃ ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানরা। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই ভূমিতে হার্ট ফাউন্ডেশনের অবকাঠামো নির্মানে নিষেধাজ্ঞাও প্রার্থনা করা হয়েছে। মামলায় ভূমিদাতা শরিকানকে মূল বিবাদী ও আরেক শরিকানকে মোকাবিলা বিবাদী করলেও, স্বউদ্যোগে ৩নং বিবাদী হিসাবে মামলায় পক্ষভূক্ত হয়েছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার এর সভাপতি।
মামলার বিবরণ ও একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে- মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ঘড়ুয়া মৌজার অন্তর্গত ৮৬নং জেএলস্থিত ৪৮২নং আরএস খতিয়ানভূক্ত ১৯টি দাগে ৩.২০৩৪ একর ভূমির মূল মালিক ছিলেন ঘড়ুয়া গ্রামের তিনভাই পন্ডিত কৈলাস চরণ দাশ, পন্ডিত সারদা চরন দাস ও পন্ডিত অন্নদা চরন দাশ। বড়ভাই পন্ডিত কৈলাস চরণ দাশ আগেই স্বর্গীয় হন। পন্ডিত সারদা চরন দাস ও পন্ডিত অন্নদা চরন দাশ দুই ভাইই ছিলেন শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী। তারা ছিলেন শিক্ষাদীক্ষা ও জ্যোতিষ শাস্ত্রসহ নানা বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞানসস্পন্ন। শিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় ভূমিকা ইত্যাদি সুবাদে তাদের বসতবাড়ীটি ‘পন্ডিত বাড়ী’ নামে ব্যাপক পরিচিত ছিল। তাদের ছিলো ৯ সদস্যের পরিবার। সারদা চরণ দাশের সন্তানরা মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই সম্ভবত ৬৩ সালের শেষ দিকে ভারতে চলে গিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যান। তারা তাদের বাবা সারদা চরণ দাশ ও কাকা অন্নদা চরণ দাশসহ পরিবারের সবাইকে স্থায়ীভাবে ভারতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, তারা জন্মভূমি ছেড়ে যেতে রাজী হননি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৯৭১ সালের ১২ মে রাজাকারদের তৎপড়তায় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন এ দুইভাই ও চলৎশক্তিহীন তাদের মা। পন্ডিত সারদা চরণ দাশ ও পন্ডিত অন্নদা চরণ দাশ শহীদ হওয়ায় এবং সারদা চরণ দাশের সন্তানরা এদেশে না থাকায়, একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসাবে তাদের পুরো ভূসম্পদের মালিক হন স্বর্গীয় কৈলাস চরণ দাশের একমাত্র পুত্র নরেশ চন্দ্র দাশ। পরবর্তীতে নরেশ চন্দ্র দাশ স্বর্গীয় হলে উক্ত ভূসম্পদের উত্তরাধিকারী হন তার দুই পুত্র পূর্ণেন্দু বিকাশ দাশ ও কানাডা প্রবাসী ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশ। আইনানুযায়ী উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত উক্ত ৩.২০৩৪ একর ভূমি সমান অংশে দুইভাই প্রত্যেকে ১.৬০১৭ একরের মালিক। পরবর্তীতে এক ভাই পূর্ণেন্দু বিকাশ দাশ স্বর্গীয় হলে উত্তরাধিকারী হন তার দুই পুত্র পংকজ দাশগুপ্ত ও কনক দাশগুপ্ত।
পন্ডিত দুইভাইয়ের জীবদ্দশা থেকে এখনও পর্যন্ত উক্ত ভূসম্পদ এজমালী রয়েছে। একপর্যায়ে নামজারীর মাধ্যমে রেকর্ড আলাদা বা বাটোয়ারা করা হলেও, সরেজমিন ভূমিসমূহের সীমানা চিহ্নিতক্রমে আলাদা বা বাটোয়ারা করা হয়নি। ভূমিসমূহ একই দাগসমূহের ভূমি এবং বাদী-বিবাদী একই দাগসমূহের ভূমির অংশীদার এবং কোন কোন দাগের ভূমির কোন কোন অংশ কে নেবেন সেটা সীমসীমানা চিহ্নিত আকারে আলাদা করা না হওয়ায় আইনানুযায়ী তা এজমালী ভূমি হিসাবেই গণ্য। এমতাবস্থায় ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশ তার মৃতঃ ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানদের সাথে কোন আলোচনা না করে, তাদের মতামত না নিয়েই কিছু ভূমি বিক্রি করেন।
এরপর থেকে স্বর্গীয় ভাইয়ের পুত্র পংকজ দাশগুপ্ত উক্ত ভূসম্পদ উভয়পক্ষের অনুকুলে ভাগ-বাটোয়ারার চেষ্টা করলেও কানাডা প্রবাসী থাকার অজুহাতে ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশ করবো-করছি করে সময়ক্ষেপণ করে আসছিলেন। বিগত ২০১৮ সালে তিনি দেশে আসলেও ভাগ-বাটোয়ারা না করে গোপনে এডভোকেট কৃপাসিন্ধু দাশ, নোটারী পাবলিক এর কার্যালয়ে ৯৬৮/২০১৮ইং নং এফিডেভিটের মাধ্যমে তার স্বত্বাংশের ভূমি সম্পর্কে তার পক্ষে ১১৮, সেন্ট্রাল রোড, মৌলভীবাজার এর বাসিন্দা মৃতঃ মোঃ আব্দুর রহমানের পুত্র মোঃ আনোয়ার ইকবালকে পাওয়ার অব এটর্নী নিযুক্ত করে কানাডা চলে যান। পরবর্তীতে ২০২২ সালে তিনি আবার দেশে এসে ইতিপূর্বেকার মতোই ১.২৭ একর ভূমি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার-কে দান করে দেয়ার মাধ্যমে অমানবিক আচরণ করেছেন তার মৃতঃ ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানদের সাথে। শুধু তাই নয়, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার-কে দান সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য গোপন রেখে সুকৌশলে ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানদেরকে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও বক্তব্য প্রদান করিয়ে তার বেআইনী দানকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছেন।
আনুষ্ঠানিকতা শেষে ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশ কানাডায় ফিরে যাবার পর একই সালের ২০ ডিসেম্বর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার এর নেতৃবৃন্দ সরেজমিন উপস্থিত হয়ে গাছ-গাছালী কর্তন করার ও বাড়ীর প্রবেশপথ বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ ও প্রচারণা করেন। এ ঘটনার পর খোঁজখবর নিয়ে প্রকৃত বিষয় জানতে পেরে তার মৃতঃ ভাইয়ের স্ত্রী কল্যাণী দাশগুপ্ত ও পুত্র পংকজ দাশগুপ্ত বাদী হয়ে মৌলভীবাজার সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে স্বত্ব বাটোয়ারা মামলা (নং- ০৬/২০২৩ইং) দায়ের করেছেন। মামলা দায়ের করার কারণে পরবর্তীতে ঘড়ুয়া এলাকার নুরুল ইসলাম কামরান, দুরুদ মিয়া, সাচ্চু মিয়া, ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশের পাওয়ার অব এটর্নী মোঃ আনোয়ার ইকবাল, হুমায়ুন আহমদ ইমন মিয়া, জুবায়ের আহমদ, নির্মল কান্তি দেব, রিপন দেব প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ এলাকার একটি বাড়ীতে বৈঠক করে মামলার বাদী কল্যাণী দাশগুপ্ত ও পংকজ দাশগুপ্তকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং তা ফেসবুকে পোস্ট করা হয়। ফলে, এলাকায় নিরাপত্তাহীন মামলার বাদী কল্যাণী দাশগুপ্ত ও পংকজ দাশগুপ্ত স্বপরিবারে শহরে বাসাভাড়া নিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশ বলেন- তিনি পুরো বাড়ী ও সম্পত্তি দান করেননি। শুধুমাত্র তার অংশটুকু দান করেছেন। সম্পত্তি বাটোয়ারা না করে কিভাবে নিজের অংশ দান করলেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- এলাকার প্রভাবশালী মানুষের উপস্থিতিতে তিনি দান করেছেন। এলাকার গন্যমান্য মানুষজন উপস্থিত ছিলেন। অতএব এ দান বৈধ।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার এর সভাপতি সৈয়দ মোসাহিদ আহমদ চুন্নু মোবাইল ফোনে বলেন- ভূমি দান প্রসঙ্গে তিনিই বলতে পারবেন, যিনি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার-কে ভূমিদান করেছেন। কারণ, তিনি ভূমির মালিক। আর, সাবরেজিষ্ট্রার বলতে পারবেন ভূমি সঠিকভাবে দান করা হয়েছে কিনা। কারণ, তিনি ভূমির দানপত্র দলিল রেজিষ্টারী করেছেন। এ ব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য নেই।
ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশের পাওয়ার অব এটর্নী মোঃ আনোয়ার ইকবাল মোবাইল ফোনে বলেন- সামনা সামনি আসেন, সব বলা যাবে। মাগরিবের নামাজের পর এমবি ক্লথ ষ্টোরে আসেন। কিন্তু, মাগরিবের নামাজের পর এমবি ক্লথ ষ্টোরে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।
মামলার বাদী স্বর্গীয় পূর্ণেন্দু বিকাশ দাশের স্ত্রী কল্যাণী দাশগুপ্ত বলেন- ভূমি দান সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য গোপন রেখে ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশ আমাদেরকে ভিন্নভাবে বুঝিয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার এর অনুষ্ঠানে নিয়েছিলেন। আমরা প্রকৃত বিষয় জানতাম না বিধায় সরল মনে অনুষ্ঠানে সহযোগীতা করেছি এবং ভবিষ্যতেও সহযোগীতা করব বলেও আশ্বস্থ করেছি। পরবর্তীতে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার এর নেতৃবৃন্দের অনাকাংখিত তৎপড়তায় সন্দিহান হয়ে আমরা খোজখবর নিয়ে প্রকৃত বিষয় জানতে পারি এবং ন্যায়বিচার পাবার জন্য আদালতে স্বত্ব বাটোয়ারা মামলা দায়ের করতে বাধ্য হই। নিশ্চয়ই আমরা ন্যায়বিচার পাব। আদালতের উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আছে।
মামলার অপর বাদী স্বর্গীয় পূর্ণেন্দু বিকাশ দাশের পুত্র পংকজ দাশগুপ্ত বলেন- আমার আলাদা কোন বক্তব্য নেই। আমার মা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা-ই আমারও বক্তব্য এবং এটাই যথার্থ।
স্থানীয় বাসিন্দা নির্মল কান্তি দেব মোবাইল ফোনে বলেন- মামলার বিষয়বস্তু জটিল নয়। উভয়পক্ষকে নিয়ে বসলে সমাধান হয়ে যাবে। বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা হিসাবে এলাকার কয়েকজন বসেছিলেন। বাদীদেরকেও ডাকা হয়েছিলো। কিন্তু, তারা আসেননি। ডাঃ সুধেন্দু বিকাশদাশ ছাড়া অন্যরা এটা সমাধান করতে পারবেন বলে মনে হয়না।