সুরমার ঢেউ সংবাদ :: শিশু অধিকার ফোরামের শিশু অধিকার পরিস্থিতি ২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী অবৈধ ক্ষণিক ‘সুখের’ বলি হচ্ছে নবজাতক। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় সময়ই উদ্ধার হচ্ছে নবজাতক। পরিত্যক্ত স্থান, ডাস্টবিন, ড্রেন, ডোবা-নালা, ঝোপ-ঝাড় সর্বত্রই জীবিত অথবা মৃত নবজাতক মিলছে। এসব ঘটনায় জড়িতরা চিহ্নিত হচ্ছেনা। পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবেও দিন দিন উদ্বেগজনক হারে এমন অনাকাংখিত ঘটনা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশ বলছে- নারী-পুরুষের অবৈধ মেলামেশার ফলে জন্ম নেয়া সন্তান সমাজ ও পরিবার মেনে না নেয়ায় জন্মের পরপরই নবজাতকদের ঠাঁই হচ্ছে বিভিন্ন পরিত্যক্ত স্থান বা ডাস্টবিনে। আর, এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তথ্য প্রমাণের ঘাটতি থাকে এবং বাদি-বিবাদিও থাকেনা। তাই, এসব ঘটনায় জড়িতদের অনেক সময় চিহ্নিত করাও সম্ভব হয়না।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন- সাধারণত বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা ধর্ষণ থেকে জন্মানো শিশুদের ক্ষেত্রেই এমন পরিণতি বেশি হচ্ছে। ছেলেশিশু প্রত্যাশা করার পর মেয়েশিশু জন্মানোর কারণেও অনেক পরিবার শিশুদের রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে বলেও অভিমত তাদের।
সম্প্রতি রাজধানীর শাহবাগের আনন্দবাজার এলাকার ফুটপাত থেকে যমজ ছেলে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শাহবাগ থানার এসআই হারুনুর রশীদ জানান- সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে কাপড় দিয়ে মোড়ানো একটি সিমেন্টের ব্যাগের ভিতর থেকে অচেতন অবস্থায় আনুমানিক একদিন বয়সী দুই নবজাতককে উদ্ধার করি। পরে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এসআই আরও বলেন- কারা নবজাতক দুটিকে ফেলে রেখে গেছে আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তা শনাক্তের চেষ্টা চলছে। নবজাতকদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে।
৩০ জুলাই বগুড়ার শিবগঞ্জ মহাস্থান গড় বানারসি গ্রামের বাসিন্দা আলিমুদ্দিনের বাড়ির সদর দরজার সামনে থেকে যাওয়া শপিংব্যাগ থেকে এক মেয়ে নবজাতক উদ্ধার করা হয়। পরে নবজাতককে বগুড়া টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড রফাতুল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ২৫ জুলাই ঢাকা নার্সিং কলেজের গেটের পাশ থেকে শপিং ব্যাগের মধ্যে কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় এক দিন বয়সি এক ছেলে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ৪ জুলাই নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের গাগলাজুর গ্রামের নির্জন হাওরের শ্মশানঘাট এলাকা থেকে ফুটফুটে এক মেয়ে নবজাতক উদ্ধার করে স্থানীয়রা। তাদের ধারণা, নবজাতকটি এলাকারই কারও হবে। কেউ হয়তো নির্জন এ শ্মশানঘাটে ফুটফুটে মেয়ে শিশুটিকে ফেলে গেছে। সময়মতো মানুষের চোখে পড়ায় প্রাণে বেঁচেছে শিশুটি।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাসুল তালুকদার ওই সময় বলেন- উদ্ধার নবজাতকটির বয়স ১ থেকে ২ দিন হতে পারে। নবজাতকটির মা-বাবার কোনো সন্ধান মেলেনি। মান্দারুয়া গ্রামের সরাজ মিয়ার পরিবার নবজাতকটিকে নিজেদের কাছে যত্নে রেখেছেন। তিনি আরও বলেন- দাবিদার কাউকে না পেলে সরাজ মিয়ার পরিবার নবজাতকটিকে লালন-পালনের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করে নিয়মানুযায়ী নবজাতকের বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। ২ জুলাই রাজধানীর চকবাজার থানাধীন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নির্মাণাধীন ভবন সংলগ্ন ডাস্টবিন থেকে এক নবজাতককে উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরে নবজাতককে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। চকবাজার থানার এসআই উদয়ন জানান, কে বা কারা ওই নবজাতককে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে যায়, তা প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে। ১০ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পাশের রাস্তায় কুকুরের মুখ থেকে এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিন বিকেলে ফুটপাতের কয়েকজন দোকানদার প্রথমে কুকুরের মুখে মরদেহটি দেখতে পায়। পরে পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়।
শাহবাগ থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে- চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজসংলগ্ন এলাকা থেকে ৯টি নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নবজাতক উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের হওয়া অপমৃত্যুর মামলাগুলোর বর্তমান অবস্থার বিষয়ে শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহ আলম বলেন- এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তথ্য-প্রমাণের ঘাটতি থাকে। অধিকাংশ ঘটনায় বাদি-বিবাদি না থাকায় মামলার সুরাহা করা যায় না। বেশিরভাগ নবজাতক এমন জায়গায় ফেলা হয়েছে যেখানে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। ফলে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণের অভাবে জড়িতদের অনেক সময় চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গত ৪ বছরে ৭১৪ নবজাতককে পরিত্যক্ত ও মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত তিন মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ৩৮টি নবজাতকের মরদেহ। সপ্রতি এমনই এক পরিসংখ্যানমূলক তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম। দেশের শীর্ষ ১৫টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তারা এ তথ্য দিয়েছে। শিশু অধিকার ফোরামের শিশু অধিকার পরিস্থিতি ২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী- গত বছর রাস্তা/ডাস্টবিন বা ঝোপ থেকে অজ্ঞাতপরিচয়ের ২১৭ নবজাতক কুড়িয়ে পাওয়া যায়। ২০২১ সালে ফেলে দেয়া বা কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতকের সংখ্যা ছিল ১২৬। অর্থাৎ এক বছরে এ ধরনের ঘটনা বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। এসব অজ্ঞাতপরিচয়ের শিশুর ৯৯ শতাংশই ছিল নবজাতক।
সাধারণত জীবিত বা মৃত অবস্থায় নবজাতক উদ্ধারের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের কাছে শিশুর নমুনা পাঠানো হয়। সেই নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে শিশুটির প্রোফাইল তৈরি করেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা। যদি কেউ শিশুর পরিচয় দাবি করে, তাহলে তাদের (দাবিকারী মা-বাবা) সঙ্গে সেই শিশুর ডিএনএ প্রোফাইল মেলানোর মাধ্যমে সেটা প্রমাণ করা হয়। কিন্তু এ শিশুদের অধিকাংশকে স্বেচ্ছায় ফেলে যায় তাদের বাবা-মা। এজন্য এর তদন্ত করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন- আমাদের ডিএনএ ব্যাংকে শুধু অপরাধীদের প্রোফাইল করা আছে। যেটার পরিসরও সীমিত। যদি বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশের সব মানুষের যদি ডিএনএ ডাটাবেজ থাকত, তাহলে সহজেই শিশুর ডিএনএ ওই ডাটাবেজের সঙ্গে মিলিয়ে মা-বাবাকে শনাক্ত করা যেত।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে সরকারিভাবে এসব শিশুর আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকলেও সচেতনতার অভাবে বা পরিচয় ফাঁস হয়ে সামাজিকভাবে হয়রানির মুখে পড়তে পারেন এমন আশঙ্কা থেকে বেশিরভাগই কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। আমাদের সামাজিক কাঠামোতে অনেক বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন- বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ও বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে। পাশাপাশি প্রযুক্তিরও অনেক বড় প্রভাব আছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ বা জন্ম নিরোধ বিষয়ে সচেতনতার অভাবও একটা বড় কারণ। এ শিশুদের যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আশ্রয় দেয়া যায়, সেটা জানা না থাকার কারণেও অনেকে এ সবের দিকে ঝুঁকছেন। এমন অবস্থায় পারিবারিক বন্ধন ও নৈতিকতার শিক্ষা দৃঢ় করা প্রয়োজন। পাশাপাশি নবজাতককে কারা ফেলে গেছে সেগুলোর সষ্ঠু তদন্ত হওয়াটাও জরুরি। এমন ঘটনা হ্রাস পাবে জড়িতদের দৃষ্টমূলক শাস্তির আওতায় আনা গেলে।