রপ্তানি পণ্য চুরি করে করে শতকোটি টাকার মালিক মৌলভীবাজারের সাহেদ ওরফে সাঈদ

রপ্তানি পণ্য চুরি করে করে শতকোটি টাকার মালিক মৌলভীবাজারের সাহেদ ওরফে সাঈদ

সুরমার ঢেউ :: রপ্তানি পণ্য চুরি করে করে শতকোটি টাকার মালিক মৌলভীবাজারের মোঃ সাহেদ ওরফে সিলেটি সাঈদ। মো. সাহেদ ওরফে সিলেটি সাঈদ এর গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারে হলেও নিজ কর্মক্ষেত্রে তিনি সিলেটি সাঈদ নামেই পরিচিত। একটি চৌকস চোরের দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বে বিদেশে রপ্তানির জন্য পোশাক বন্দরে নেয়ার পথে মহাসড়কে গাড়ি আটকে চুরি, ডাকাতি করতো একটি দল। আর এভাবে চুরি করতে করতেই সিলেটি সাঈদ বনে গেছেন শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক।
রপ্তানির পোশাক চুরির একটি ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে মো. সাহেদ গ্রেপ্তার হবার পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাব বলছে- দুইদশকে রপ্তানির পণ্য চুরি করে সাহেদ শত কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন। ৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে সাহেদ এবং ইমারত হোসেন সজল, শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ ও হৃদয় নামে তাঁর ৩ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারে হলেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে পণ্য চুরিতে সুবিধা পাবার জন্য মো. সাহেদ ওরফে সিলেটি সাঈদ থাকতেন চট্টগ্রামে। তবে তাঁর পরিবার পরিজন মৌলভীবাজারেই বসবাসরত।
জানা গেছে- রপ্তানির পণ্য চুরির টাকা দিয়েই তিনি নিজের জেলা মৌলভীবাজার সদরের দুর্লভপুর গ্রামে তৈরি করেছেন দুটি বিলাসবহুল বাড়ি। এর একটি ২০ একর জমি নিয়ে। এই বাড়িতে ট্রিপ্লেক্স ভবন, ১টি মাছের খামার ও ২টি হাঁস-মুরগির খামার রয়েছে। এ বাড়িতে থাকেন তার ছোট স্ত্রী ।
বাড়িটি তৈরিতে সাহেদ ১৫ কোটির বেশি টাকা ব্যয় করেছেন বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাঁদের দেয়া তথ্যমতে- সাহেদ দুর্লভপুর গ্রামেই তৈরী করেছেন আরেকটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। এ বাড়িতে থাকেন তাঁর বড় স্ত্রী। এছাড়া নামে-বেনামে অন্তত ২০টি কাভার্ড ভ্যান রয়েছে সাহেদের।
র‌্যাব বলছে- মহাসড়কে রপ্তানির পোশাক চুরির বেশিরভাগ ঘটনা সাহেদের নেতৃত্বে অথবা পরিকল্পনায় সংঘটিত হয়। তাঁর দলে ৪০ থেকে ৫০ জন সদস্য রয়েছেন। চক্রে অসাধু গাড়িচালক, চালকের সহকারী, গুদামমালিক, গুদাম এলাকার আশ্রয়দাতা, চুরির মালামাল নামাতে দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল শ্রমিক রয়েছেন।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন- সাহেদের চক্রের সদস্যরা রপ্তানির পোশাক পরিবহনে সম্পৃক্ত কাভার্ড ভ্যানের চালক ও তাঁর সহকারীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে রপ্তানির পণ্য চুরির কাজে উৎসাহিত করা হয় চালক এবং তাঁর সহকারীকে। চুরির আগে চালকদের মাধ্যমে রপ্তানি পণ্যের নমুনার ছবি তুলে চক্রের সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হত। প্রতিটি চুরিতে তাঁদের লক্ষ্য থাকত ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার পোশাক। ১টি চুরির পর চালককে ৩০ হাজার, তাঁর সহকারীকে ২০ হাজার, গুদামের মালিককে ৫০ হাজার এবং গুদাম এলাকায় এই চক্রের আশ্রয়দাতাকে ৬০ হাজার টাকা দেয়া হতো।
র‌্যাবের ভাষ্য- কাভার্ড ভ্যানে ওঠানো রপ্তানির পোশাকের প্রতিটি কার্টনে অনেক পোশাক থাকে। চোরেরা একেকটি কার্টন থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পণ্য চুরি করেন। এরপর বাক্সে সমপরিমাণ ঝুট বা অন্য কিছু ভরে রাখা হয়। কারখানা থেকে বন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবার আগে কাভার্ড ভ্যানে তালা লাগিয়ে সিলগালা করে দেয়া হয়। চোর চক্রের সদস্যরা তালা না ভেঙে নাটবল্টু খুলে কাভার্ড ভ্যানের উপরিকাঠামোই খুলে ফেলতেন। এরপর তাঁরা মালামাল সরিয়ে নিতেন। এভাবে সিল ও তালা অক্ষতই থাকতো। বন্দরে পণ্য নামানোর সময় চুরির বিষয়টি সাধারণত ধরা পড়েনা।
গ্রেপ্তার ৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‌্যাব বলছে- ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর গাজীপুর থেকে পোশাক কাভার্ড ভ্যানে তুলে সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কাভার্ড ভ্যানে পণ্য ঢোকানোর পর কারখানা কর্তৃপক্ষ চালক শাহজাহানকে নমুনা হিসেবে কিছু সোয়েটার দেয়। শাহজাহান নমুনার ছবি তুলে সাহেদের কাছে পাঠান। সাহেদ এ ছবি তাঁর অন্যতম সহযোগী তাওহীদুল ওরফে কাউছারের কাছে পাঠান। কাউছার যোগাযোগ করেন চালক শাহজাহানের সঙ্গে। কাউছারের নির্দেশে মধ্যরাতে ডেমরার মিরপাড়ার আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গুদামে কাভার্ড ভ্যান নিয়ে যান শাহজাহান। সেখানে কুলিসর্দার নাজিম, স্থানীয়ভাবে আশ্রয়দাতা মাসুম ওরফে মাসুদসহ আরও ৫/৭ জন প্রতিটি কার্টনের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পণ্য সরিয়ে নেন। পরে পুনরায় প্যাকেজিং করে কাভার্ড ভ্যানটি বন্দরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কাউছার, নাজিম ও মাসুমকে গত ২৪ ডিসেম্বর অন্য একটি চুরির মামলায় ঢাকার ডেমরা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাঁরা এখন কারাগারে আছেন।
র‌্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন- গ্রেপ্তার ইমারত হোসেন (সজল) ২০১২ সাল থেকে ঢাকার উত্তরায় গার্মেন্টস পণ্যের ‘স্টকলটের’ ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসা করতে গিয়েই সাহেদ, কাউছারসহ চোর চক্রের সদস্যদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে সাহেদের কাছ থেকে চুরির পণ্য কম দামে কিনে বিক্রি শুরু করেন। গত ২ বছরে ১৫০ থেকে ২০০টি চুরির পণ্য কিনে বিক্রি করেছেন তিনি। এর মধ্যে অনেক পণ্য তিনি বিদেশেও রপ্তানি করেছেন। চুরির পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে তিনিও কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *