সুরমার ঢেউ সংবাদ :: অস্কার খ্যাত “ব্রিটিশ কারী এওয়ার্ড”-এর ফাউন্ডার কারী কিং মরহুম এনাম আলী এমবিইকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো ১৮তম ব্রিটিশ কারী এওয়ার্ডের রাজকীয় অনুষ্ঠান। ২৮ নভেম্বর সোমবার সেন্ট্রাল লন্ডনের বাটারসি এভুলেশন পার্কে নির্মিত কারী অস্কারের সুবিশাল হলে চোঁখ ধাধাঁনো আয়োজনে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ কারী অ্যাওয়ার্ড মঞ্চকে বরাবরের মতোই বর্ণিল করে তুলেন বিশ্বখ্যাত সেলিব্রেটিরা। কারী ইন্ডাস্ট্রির প্রেস্টিজিয়াস এ আয়োজনে যেমন থাকে ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির বর্ণিল পরিচয়, তেমনি শৈল্পিক ব্রিটিশ কারী এওয়ার্ডকে অন্য সব আয়োজন থেকে ব্যতিক্রমী করে তোলার মাধ্যমে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন ইভেন্ট মাস্টার খ্যাত এনাম আলী এমবিই।
দীর্ঘ দেড় যুগের পথচলায় এনাম আলী এমবিই পূর্ব পুরুষের শ্রম ও ঘামে গড়ে উঠা ব্রিটেনের অর্থনীতিতে সরাসরি বিলিয়ন পাউন্ডের অবদান রাখা এ কারী ইন্ডাস্ট্রিকে শুধু ব্যবসা নয়, একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে অবিরাম কাজ করেছেন তাঁর জীবনের ৪৫ বছর। চলতি বছরের জুলাই মাসে মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন কারী শিল্পের এ কিংবদন্তি এনাম আলী এমবিই। তাই, অন্য সময়ের চেয়ে এবারের ব্রিটিশ কারী অ্যাওয়ার্ড ছিল গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় মুহ্যমান। সবকিছু সময়ের গতিতে চললেও এনাম আলী বিহীন এ আয়োজনটি ছিল শোকে আচ্ছন্ন। উপস্থিত অথিতিদের মুখে ছিল গভীর শোক ও শ্রদ্ধা প্রকাশের পাশাপাশি কারী শিল্পের বিকাশে তাঁর অনন্য কাজগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার শপথ।
অনুষ্ঠানে নব প্রতিষ্ঠিত এনাম আলী ফাউন্ডেশনের জন্য অনুষ্টিত অকশনে উপস্থিত মানুষ দুই হাত খুলে এগিয়ে আসেন। ১০টি আইটেম থেকে প্রায় কোটি টাকার (প্রায় ৮০ হাজার পাউন্ড) ফান্ড সংগ্রহ করা হয় তাৎক্ষণিক ভাবে। শুধুমাত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সাইন দেয়া একটা চিঠি অকশনে বিক্রি করা হয় ৫০ হাজার পাউন্ড. এ টাকা বিলেত ও বাংলাদেশে ক্যান্সার সংক্রান্ত চ্যারিটিতে খরচ করা হবে বলে জানা যায়।
ব্রিটিশ কারী এওয়ার্ড এর প্রযোজক এনাম আলী এমবিই’র কন্যা জাস্টিন আলীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও সেলিব্রেটি প্রেজেন্টার ও কমেডিয়ান, অভিনেতা ও লেখক হিউ ডেনিসের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন ব্রিটিশ কারী এওয়ার্ডের ডিরেক্টর মরহুম এনাম আলী এমবিই’র পুত্র জেফ্রি আলী। উদ্বোধনী বক্তব্যে শোকে আপ্লুত জেফ্রি আলী বাবার জন্য দোআ কামনা করে বলেন- জীবনের ৪৫ বছর আমার বাবা এনাম আলী এমবিই কারী ইন্ডাস্ট্রির উন্নতি ও এ শিল্পের সাথে জড়িতদের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি বলতেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা সাধারণ কোনো ব্যবসা নয়, এটি একটি শিল্প এবং এর আধুনিকায়নে তাঁর কাজ ছিল গতানুগতিক ধারার বাহিরে। বাবা স্বপ্ন দেখতেন, নতুন প্রজন্মকে কারী ইন্ডাস্ট্রির সাথে সম্পৃক্ত করার এবং এ জন্য যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এর আধুনিকায়নে তিনি ব্রিটিশ সরকারের সর্বোচ্চ মহলে দাবি জানাতেন।
ব্রিটিশ কারী এওয়ার্ড ডিরেক্টর জেফ্রি আলী বর্তমান কারী শিল্পের সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেন- একদিকে স্টাফ সংকটের কারণে যখন বিলিয়ন পাউন্ডের কর প্রদানকারী শিল্পটি ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হচ্ছিলো তখনও ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা ছিল শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য প্রায় ৪৫ ভাগ বৃদ্ধির কারণে টিকে থাকা এখন যুদ্ধের মতো হয়ে যাচ্ছে। জেফ্রি বলেন- পেঁয়াজের দাম এখন আকাশচুম্বী। তেল ছাড়া যেখানে খাবার তৈরী সম্ভব নয়, সেখানে তেলের দাম এখন ধরা ছোয়ার বাহিরে চলে গেছে। পরিস্থিতিকে সংকটময় উল্লেখ করে জেফ্রি বলেন- আমার বাবা সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজ করার স্বপ্ন দেখতেন। আসুন আমরা এ সংকট উত্তরণে একসাথে কাজ করি।
অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায়- প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন- ”আমার জীবনে কাজের সবচেয়ে বড় প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র ছিল কারী হাউজে কাজ করা। এ কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি একটি রেষ্টুরেন্টের ম্যানেজার, শেফ, ওয়েটার, ডেলিভারি ড্রাইভার কতটা পরিশ্রম করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে সেই অভিজ্ঞতা আমাকে যে প্রশিক্ষণ দিয়েছে সেটা হলো, মানুষের সাথে ন্যায্য আচরণ করার গুরুত্ব। প্রধানমন্ত্রী বলেন- ব্রিটিশ এশিয়ান শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে আইকনিক শিল্প হলো কারী শিল্প। মরহুম এনাম আলী এমবিই ও তাঁর অনবদ্য তৈরী ব্রিটেনের ‘কারি অস্কার’কে সমর্থন করতে পেরে আনন্দিত উল্লেখ করে তিনি বলেন- এনাম আলী এমবিই আপনি আমাদের জন্য এবং আমাদের ভবিষ্যৎ জেনারেশনের জন্য যা কিছু করেছেন এবং রেখে গেছেন এজন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।”
যুক্তরাজ্যের কারী শিল্পের প্রেস্টিজিয়াস অনুষ্ঠান হিসাবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এ এওয়ার্ডকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ‘কারি অস্কার’ উল্লেখ করে বলে ছিলেন- ব্রিটেনের মানুষের হাউজ হোল্ড খাবার চিকেন টিক্কা মসল্লা। ব্রিট্রিশ নাগরিকরা এ খাবার ছাড়া সপ্তাহের একটি দিনও চিন্তা করে না। এ শিল্পকে উচ্চ মর্যাদায় নিয়ে যেতে কাজ করছেন এনাম আলী এমবিই এবং “কারী অস্কার” ব্রিটিশ কারী অ্যাওয়ার্ড।
বরাবরের মতোই ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড-এর ১৮তম অনুষ্ঠানে রাজনীতি, খেলাধুলা, শোবিজ এবং খ্যাতনামা ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন টিভি ব্যক্তিত্ব ক্রিস ট্যারান্ট, নাদিয়া এসেক্স (সেলেব গো ডেটিং), ডঃ রঞ্জ সিং, মার্লিন গ্রিফিথস, হেইলি স্পার্কস (দিস মর্নিং), ড্যানিয়েল ম্যাসন, সায়রা খান, অভিনেতা জেমস কসমো, নিনা ওয়াদিয়া, প্রাক্তন ইংল্যান্ড ফুটবলার ডেভিড সীম্যান, আইস স্কেটার ফ্রাঙ্কি পোল্টনি, সাবেক ইংল্যান্ড ক্রিকেটার ফিল টাফনেল, রিয়েলিটি টিভি তারকা ফারাহ সাত্তার, শিক্ষানবিশ প্রতিযোগী নিক শাওয়ারিং ও এমপি ক্রিস গ্রেলিং। অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল শীর্ষস্থানীয় অনলাইন ফুড অর্ডারিং এবং ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম জাস্ট ইট।
ব্রিটিশ কারী অ্যাওয়ার্ড ২০২২ পেলেন যারা : স্কটল্যান্ড এর শ্রেষ্ট রেস্টুরেন্ট এওয়ার্ড অর্জন করে গ্লাসগো’র ‘স্বদেশ রেস্টুরেন্ট’, নর্থ-ইস্ট ইউকের শ্রেষ্ঠ রেস্টুরেন্টের এওয়ার্ড অর্জন করে নিউক্যাসল-এর খাই খাই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট, নর্থ-ওয়েস্ট ইউকের শ্রেষ্ঠ রেস্টুরেন্ট এর এওয়ার্ড অর্জন করে লিভারপুল-এর মোগলি স্ট্রিট ফুড, ইস্ট মিডল্যান্ডস’র শ্রেষ্ট রেস্টুরেন্ট এওয়ার্ড অর্জন করে নটিংহাম-এর ‘ক্যালকাটা ক্লাব’ রেস্টুরেন্ট, ওয়েস্ট মিডল্যান্ডস এর শ্রেষ্ট এওয়ার্ড অর্জন করে বার্মিংহামের ‘লাসান রেস্টুরেন্ট’, ওয়েলসের শ্রেষ্ঠ রেস্টুরেন্ট এওয়ার্ড অর্জন করে কার্ডিফ-এর ‘পার্পেল পপপাডম’, সাউথ ইস্ট এর সেরা রেস্টুরেন্ট এওয়ার্ড অর্জন করে কেন্টের ওয়েস্টারহ্যামের ‘শ্যাম্পান অ্যাট স্পিনিং হুইল’ রেস্টুরেন্ট, দক্ষিণ পশ্চিমের শ্রেষ্ঠ রেস্তোরাঁ পৃথ্বী রেস্তোরাঁ, চেলটেনহ্যাম সেন্ট্রাল লন্ডন এবং সিটি’র সেরা এওয়ার্ড অর্জন করে মেফেয়ার‘র বেনারস রেস্টুরেন্ট, লন্ডন সিটির পাশ্ববর্তী শ্রেষ্ঠ রেস্টুরেন্ট এওয়ার্ড অর্জন করে ব্রমলি‘র ‘কপার সিলন’, সেরা টেকওয়ে’র এওয়ার্ড অর্জন করে জেরার্ডস ক্রস এর ‘মালিকস এক্সপ্রেস কিচেন’, বেস্ট নিউ কামার এওয়ার্ড অর্জন করে হলবর্ণের ‘কর্নেল সাব’ এবং বর্ষসেরা কারী ব্যক্তিত্বের এওয়ার্ড অর্জন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল পুরস্কার প্রাপ্ত সেফ ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান। এওয়ার্ড অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ সংখ্যক লাইভ পাবলিক ভোটের ভিত্তিতে ডিনারস চয়েস এওয়ার্ড অর্জন করে ব্রিস্টলের আরবান তান্দুরি।