সুরমার ঢেউ সংবাদ :: বছরে ৫শ থেকে ১ হাজার মানুষ মারা যায় বজ্রপাতে। দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। এতে জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাতে মৃত্যু হয় হঠাৎ, এই মৃত্যু রোধে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। পাশাপাশি নিতে হবে বজ্ররোধক ব্যবস্থা। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ঘটে বজ্রপাতে প্রাণহানি। এ নিয়ে জনমনে দিন দিন উদ্বেগ বেড়েই চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমিয়ে আনার জন্য ২০২১ সালে সরকার সারা দেশে ১০ লাখ তালগাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তালগাছ নয়, ২৮ লাখ তালের আঁটি রোপণ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা সম্পর্কে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ ও জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবই এর মূল কারণ। আরো দুটি কারণের কথা বলেছেন তারা। এর একটি হলো জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া এবং উঁচু গাছগুলো কেটে ফেলা। প্রাপ্ত তথ্য মতে, নানা প্রতিকূলতায় বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রিস্কফ্যাক্টরস অ্যান্ড সোশ্যাল ভালনারেবিলিটি’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০টি বজ্রপাত হয়। বছরে দেড়শোর মতো লোকের মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা পাঁচশ থেকে এক হাজার। বজ্রপাত-সচেতনতায় কাজ করা সংগঠন সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম (এসএসটিএএফ) বলছে, এ অবস্থা থেকে দ্রুত পরিত্রাণের জন্য পাঠ্যপুস্তকে বজ্রপাত-সচেতনতা ও মাঠে বজ্ররোধক টাওয়ার নির্মাণ জরুরি।
চলতি বছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২৯ ও ৩০ এপ্রিল এই দুদিনে বজ্রপাতে ৩২ জন নিহত হয়েছে। আর এসএসটিএএফের তথ্য মতে, বজ্রপাতে দেশের ১১ জেলায় গত শুক্রবার (১৭ জুন) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৯ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ময়মনসিংহে ৬, সিরাজগঞ্জে ৩ এবং রাজশাহীতে দুজন মারা গেছেন। এ ছাড়া নওগাঁ, বগুড়া, জামালপুর, ঢাকা, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা, গাজীপুর ও দিনাজপুরে একজন করে মারা গেছেন। আর গতকাল দুপুরে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় বজ্রাঘাতে তিন জেলের মৃত্যু হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন দুজন। এদিন পৃথক স্থানে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর ধুরং ইউনিয়নের চুল্লার পাড়ার জাকের উল্লাহর ছেলে মো. আক্কাস (২২), দক্ষিণ ধুরং কাঁচা এলাকার ছাবের আহমদের ছেলে মো. করিম (২৮) এবং পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের শরৎ ঘোনা এলাকার মো. হোসেনের ছেলে রমজান আলী। দুর্যোগ ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ২০৫, ২০১৬ সালে ২৪৫, ২০১৫ সালে ১৮৬, ২০১৪ সালে ২১০, ২০১৩ সালে ২৮৫, ২০১২ সালে ৩০১ এবং ২০১১ সালে ১৭৯ জন বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন। আর চলতি বছরের গত ১৭ জুন পর্যন্ত পঞ্চাশ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে বজ্রপাতে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উপপরিচালক) কাওসারা পারভীন বলেন, বজ্রপাত আগেও ছিল, এখনো আছে। বছরের পুরো সময় যে পরিমাণ বজ্রপাত হয়; তার কয়েক গুণ বেশি হয় বর্ষা মৌসুমে। একটি বজ্রমেঘ থেকে ৬০-৭০ হাজার বজ্রপাত হয়। মেঘের ঘর্ষণে কিছু ওপরের দিকে উঠে যায় এবং কিছু মাটিতে নেমে আসে। যেগুলো নিচে পড়ে সেগুলো উঁচু তালগাছ ও নারিকেল গাছ কিছুটা প্রতিরোধে সহায়ক হয়। বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ লাগানোর প্রকল্প প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই গবেষক বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো তালগাছ লাগানো হয়েছে কি না জানা নেই। দেশের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে (আটটি স্থান) বজ্রমেঘগুলো প্রবেশ করে। আর কিছু মেঘ ঢোকে উত্তর-পূর্বদিক থেকে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চল (ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ) এগুলো নিচু এলাকা হওয়ায় সেখানে বজ্রমেঘ বেশি হয়। বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। কারণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ঠেকানো কঠিন। এগুলো আসবে। তবে কীভাবে আমরা টিকে থাকতে পারি সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, এক দিনে নিহত ১৯ জনের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের মধ্যে আট জন শিশু-কিশোর এবং চার জন কৃষক। ফুটবল খেলতে গিয়ে তিন শিশু-কিশোর, একজন মাঠে গরু চড়াতে গিয়ে এবং মাছ ধরতে গিয়ে দুজন মারা গেছে। ময়মনসিংহে একই পরিবারের তিন শিশুসহ ছয় জন মারা গেছে। নিহত শিশুরা হলো : উপজেলার কংকরহাটি গ্রামের শহীদল্লাহর ছেলে সাঈদ মিয়া (১২), হাদিস মিয়ার ছেলে স্বাধীন মিয়া (১১) এবং বিল্লাল হোসেনের ছেলে মো. শাওন (৮)। একই জেলার সদর উপজেলার দড়িকুষ্টিয়া বাল্লাপাড়া গ্রামের কৃষক আবু বকর (৪০) ও জাহাঙ্গীর আলম (৩০)। নান্দাইল ও ধোবাউড়া উপজেলার চরমুহিনী গ্রামের আবু সাঈদ (৩০)। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জে পৃথক দুটি বজ্রপাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর নিরাপত্তা প্রহরীসহ তিনজন মারা গেছেন। এদের মধ্যে একজন হলেন উপজেলার সায়দাবাদ ইউনিয়নের সায়দাবাদ শিল্পপার্ক এলাকার জাহাঙ্গীর আলম খানের ছেলে নাসির উদ্দিন (১৭)। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে যমুনার চরাঞ্চলের বর্ণি এলাকায় দরবেশ আলী মুনশির ছেলে আবদুর রাজ্জাক মুনশি মারা যান। এ ছাড়া দুর্গা চরন (৫২) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে।
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের (এসএসটিএএফ) সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোল্লা বলেন, ‘বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে হলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর এজন্য বজ্রপাত সচেতনতার বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মাঠে মাঠে বজ্ররোধক টাওয়ার নির্মাণ করতে হবে। তিনি বলেন, মারা যাওয়া ১৯ জনের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, একই পরিবারের তিন শিশু ফুটবল খেলতে গিয়ে, এক শিশু মাছ ধরতে গিয়ে ও এক কিশোর মাঠে গরু চড়াতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যায়। আমাদের দেশে বৃষ্টি হলেই শিশু-কিশোর ফুটবল নিয়ে মাঠে খেলতে বের হয়। কিন্তু তারা ও তাদের পরিবার জানে না আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে এবং বৃষ্টির সময় বজ্রপাত বেশি হয়। এজন্য সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।’
তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানি বাড়ছে। বজ্রপাতে ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক দশকে মারা গেছেন ২ হাজার ৭৮৫ জন। গত ১৭ জুন শুক্রবার বজ্রপাতে একদিনে মারা গেছেন ১১ জন। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বছরের মে থেকে জুন পর্যন্ত এ সময় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। আর জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের প্রভাবে বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। ফলে বাড়তি আর্দ্রতার প্রভাব ফেলছে বর্ষা ঋতুর বৈচিত্র্যে। আর এতে বাড়ছে বজ্রপাত, ঘটছে প্রাণহানি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে। বেশি মারা যান মাঠে কাজ করা কৃষক। আর আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বজ্রপাতের কারণে বছরে গড়ে দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, বজ্রপাত রোধে সারা দেশে গাছ রোপণ করতে হবে। গাছ বজ্রপাত থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখে। আর হাওর অঞ্চলে যেহেতু বজ্রপাত বেশি হয়, সেখানে প্রচুর ছাউনি নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়া বজ্রপাত নিয়ে মানুষের মধ্যে আরো বেশি সচেতনতা দরকার। ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের রিসার্চ ফেলো প্রকৌশলী মনির হুসাইন বলেন, ‘আগেও বজ্রপাতে মানুষ মারা যেত। কিন্তু আমরা জানতে পারতাম না। এখন প্রযুক্তির কারণে আমরা জানতে পারি।’ তিনি আরো বলেন, ‘বজ্রপাত থেকে মৃত্যুহার কমানোর জন্য সরকার কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। শিগগির প্রজেক্টগুলো নিয়ে কাজ শুরু হবে। এপ্রিল, মে ও জুনে বজ্রপাতের তীব্রতা বেশি থাকে। ফলে এ সময় মানুষ যদি নিরাপদে অবস্থান না করে তাহলে বজ্রপাত শরীরে পড়তে পারে। এ সময়টায় সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে চলাচলের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।’ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রনাথ বর্মণ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুর্যোগ ও বজ্রপাতে প্রাণহানি এড়াতে গত মাসে আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এ বিষয়ে আমরা যাচাই-বাছাই করেছি। বাস্তবায়ন করবে সরকারের দুর্যোগ অধিদপ্তর। এর আগে এটার ওপরে একটা মাঠজরিপ করেছি। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ও আবহাওয়া বিভাগের বিশেষজ্ঞরা সম্পৃক্ত ছিলেন। এ বিষয়ে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য শিগগির পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হবে।’