সুরমার ঢেউ সংবাদ :: মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের পুরনো সেগুন বাগানের ভেতরের কাঁচা রাস্তা পাকাকরণের কাজ শুরু করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তবে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন না নেয়ায় কাজ বন্ধ রাখতে স্থানীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলীকে তিন দফা চিঠি দেয়া হয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন- সমৃদ্ধ এ সংরক্ষিত বনের ভেতরে পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হলে পুরনো সেগুন বাগান রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং বনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সঙগত কারণেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে পাকা রাস্তা কার স্বার্থে ?
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে- লাঠিটিলা এলাকায় লালছড়া থেকে রুপাছড়া পর্যন্ত কাঁচা সড়কের এক কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণ কাজের জন্য এলজিইডি দরপত্র আহ্বান করে। প্রায় ৯৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘প্যারাডাইস কনস্ট্রাকশন’ নামের স্থানীয় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি পায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেশ কয়েকদিন থেকে কাজের জন্য সড়কের পাশে ইট স্তূপ করতে শুরু করে এবং ২১ এপ্রিল এক্সেভেটর দিয়ে মাটি কাটার কাজ শুরু করেছে। স্থানীয় বন বিভাগের লোকজন বিষয়টি জানতে পেরে মৌলভীবাজার জেলার (শ্রীমঙ্গল) সহকারী বন সংরক্ষককে লিখিতভাবে জানান। এর আগে ১০ এপ্রিল স্থানীয় লাঠিটিলা বিটের বিট কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন এবং ১৪ এপ্রিল রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন রাস্তার কাজ বন্ধ রাখতে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলীকে পৃথক পৃথক চিঠি দেন। ওই চিঠিতে সংরক্ষিত বন এলাকায় কোনো ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না করার বিষয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। এছাড়া রাস্তাটির কাজের দরপত্র আহ্বানের আগে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো পরামর্শ বা অনুমোদন নেয়া হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়। তাই, অনতিবিলম্বে কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়। এছাড়া বিট কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সংরক্ষিত বন এলাকায় নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ হতে বিরত থাকার জন্য এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলীকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন।
কিন্তু জুড়ী এলজিইডি সে সকল চিঠিকে তোয়াক্কা না করে রাস্তার কাজ শুরু করে। শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় ৫০০ ফুট রাস্তায় মাটি খোদাই করে রাখা হয়েছে। বন বিভাগ জানায়- জুড়ী রেঞ্জের অধীন লাঠিটিলা বিটে পাথারিয়া হিল রিজার্ভ বনের আয়তন ৫ হাজার ৬৩০ দশমিক ৪০ একর।
উল্লেখ্য- ১৯২০ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে এ বনকে সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষণা করে। সেখানে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৫০ হাজার পুরনো সেগুন গাছ, প্রাকৃতিক বন, সৃজিত বিভিন্ন ধরনের বনজ গাছের বাগান, বাঁশমহাল ও বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণী রয়েছে। এটি সিলেট বিভাগের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ বনাঞ্চল।
বন বিভাগ আরো জানায়- বনভূমির মধ্যে যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প গস্খহণ সংক্রান্ত বিষয়ে ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সভার সিদ্ধান্ত মতে, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বনভূমির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল, প্রজনন ক্ষেত্র হ্রাস পাচ্ছে, নির্জন পরিবেশ সংকুচিত হচ্ছে। বন, বনভূমি, পরিবেশ, প্রতিবেশ, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই, বনভূমির মধ্যে যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে বন বিভাগের মাধ্যমে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেয়ার কথা বলা হয়। এছাড়া সব উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত ও নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় রাখতে বলা হয়। পরে সভার কার্যবিবরণীর বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিচালক-১৪ ড. মো. সহিদ উল্যাহ স্বাক্ষরিত চিঠি দেয়া হয়।
জুড়ী বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ আলাউদ্দিন বলেন- লাঠিটিলা বনে রাস্তার কাজের ব্যাপারে আমাদের কাছ থেকে আগে কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। এছাড়া পাকা রাস্তাটি হলে ওই এলাকার পুরনো সেগুনবাগান রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। কাঠ চোরাকারবারিদের তৎপরতা বেড়ে যাবে। এ কারণে কাজ বন্ধ রাখতে এলজিইডি প্রকৌশলীকে বন বিভাগের পক্ষ থেকে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছি এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি।
এলজিইডির জুড়ী উপজেলা প্রকৌশলী মো. আব্দুল মতিন মুঠোফোনে বলেন- পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী স্থানীয় মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা) আসনের সাংসদ মো. শাহাব উদ্দিনের নির্দেশে কাজ করানো হচ্ছে। সংরক্ষিত বনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে কিভাবে কাজ শুরু করলেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনুমতির ব্যবস্থা মন্ত্রী করবেন। এ বিষয়ে আমার আর কোনো বক্তব্য নেই। ‘
এলজিইডির মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আজিম উদ্দিন সরদার শনিবার দুপুরে মুঠোফোনে বলেন, ‘এটা ঠিক যে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে হলে অনুমতি লাগে। লাঠিটিলা এলাকাটি আমাদের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিননের নির্বাচনী এলাকা জুড়ী উপজেলার মধ্যে পড়েছে। তাই, তিনি ডিও লেটারের মাধ্যমে ওই এলাকায় এক কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব করেন। পরে প্রস্তাবটি প্রকল্প পরিচালকের কাছে যায়। বিষয়টি মন্ত্রীর জানা। তাই, আলাদাভাবে চিঠি দিয়ে অনুমতি নেয়া হয়নি। তবে, এই এলাকায় পাকা রাস্তা হলেও বনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র যেন ঠিক থাকে এবং সেগুন পাচার যাতে না হয় সে জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ যেন নজরদারি রাখে। কাজ শুরু করার পর স্থানীয় বন বিভাগ আপত্তি দিলে বিষয়টি উপজেলা প্রকৌশলী আমাকে জানান। বিষয়টি জেনে উপজেলা প্রকৌশলীকে মন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ শুরু করার কথা বলেছি।