ইশরাত জাহান চৌধুরী :: সিলেটের সর্বাধিক উন্নয়নের রূপকার হিসেবে সারা বাংলাদেশব্যাপী যার পরিচিতি তিনি একমাত্র এম সাইফুর রহমান। ভাষা আন্দোলনে কারাবরণকারী নেতা , বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, অর্থনীতিবিদ, দীর্ঘসময়ের অর্থমন্ত্রী, ১২ বার বাজেট পেশকারী, সিলেটের উন্নয়নের রূপকার এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত এম সাইফুর রহমান ১৯৩২ সালে মৌলভীবাজার জেলা সদরের বাহারমর্দন গ্রামে ৬ই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল বাছিত এবং মা তালেবুন্নেসা। তিন ভাইয়ের মধ্যে সাইফুর রহমান ছিলেন সবার বড়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাবেক সফল অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ২০০৯ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর সিলেট সফর শেষে ঢাকায় ফেরার পথে ঢাকা-সিলেট মহসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের খাড়িয়াল এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। সাইফুর রহমান পেশায় একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ছিলেন। ১৯৬২ সালে পেশাজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে একমাত্র সদস্য মনোনীত হন। তিনি ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্যও ছিলেন। তিনি ‘রহমান, রেহমান অ্যান্ড হক’ নামে একটি নিরীক্ষা ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি স্পেনের মাদ্রিদে বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সুবর্ণ জয়ন্তী সম্মেলনের গভর্নর নির্বাচিত হন।১৯৮০ থেকে ১৯৮২ ও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ মেয়াদে তিনি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, আইএফএডিতে বাংলাদেশের গভর্নর ছিলেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫ মেয়াদে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এম সাইফুর রহমানের জাতীয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে। জাগদল বিলুপ্ত করে ১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি’র জন্ম। এম সাইফুর রহমান বিএনপির একজন প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যও ছিলেন। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন সিলেট-১৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথমে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরে আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাইফুর রহমান ১৯৯১ সালে দ্বিতীয়বার অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো করের পরিসর বৃদ্ধির লক্ষ্যে মূসক (মূল্য সংযোজন কর) প্রথা প্রবর্তন করেন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে সিলেট-৪ আসন থেকে, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ ও সিলেট-৪ আসন থেকে, ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ ও মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী ছিলেন। বাংলাদেশে মুক্ত বাজার সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রবর্তক হিসেবে সমধিক পরিচিতি। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন নেতা ও সফল অর্থমন্ত্রী ছিলেন। যিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ১২ বার বার্ষিক বাজেট পেশকারী অর্থমন্ত্রী। সফল এই অর্থমন্ত্রী মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়ার পর দি এইডেড হাই স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫১ সালে সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে আইএ পাস করে ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন এবং কারাবরণ করেন। পরে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৫৩ সালে লন্ডনে চলে যান। সেখানে দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস (আইসিএইডাব্লিউ) থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিএ) ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্যে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করেন। সাইফুর রহমান বেগম দূররে সামাদ রহমানের সাথে ১৯৬০ সালে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তিনি তিন ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের বাবা। ২০০৩ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তার স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। তার পুত্র এম নাসের রহমান মৌলভীবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। বরেণ্য এই রাজনীতিবিদ ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টায় ঢাকা-সিলেট মহসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের খাড়িয়াল এলাকায় দুর্ঘটনায় পতিত হন। রাস্তা থেকে গাড়িটি ছিটকে পাশের খাদে পড়ে যায়। এ সময় তাকে দ্রুত উদ্ধার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেদিন বৃহত্তর সিলেটসহ সারাদেশে তার অগণিত ভক্ত অনুরাগীর মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।