সুরমার ঢেউ সংবাদ :: অনেকগুলো চা বাগানের অবস্থানের কারণে চায়ের রাজধানী হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা। সেইসাথে বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্যের কারণেও ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে এ উপজেলার। এছাড়া রেল যোগাযোগ ভাল থাকায় অতীতে শ্রীমঙ্গল উপজেলা ছিল মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম বানিজ্যিক এলাকা। কিন্তু, আশির দশক থেকে অন্যসব এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার সাথে সাথে এ জৌলুস হারায় শ্রীমঙ্গল। তবে বর্তমান শতাব্দিতে এ চিত্র প্রায় পুরোপুরি বদলে গেছে।
শ্রীমঙ্গলের অর্থনীতি বদলে দিয়েছে পর্যটন। এখনাকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এখন অনেকটাই পর্যটন নির্ভর। গত ২০ বছরে পর্যটন হয়ে ওঠেছে শ্রীমঙ্গলের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। স্থানীয় প্রশাসনের হিসেবে, প্রতিদিন অন্তত ৫ হাজার পর্যটক আসেন শ্রীমঙ্গলে।
ইতিপূর্বে শ্রীমঙ্গলের ব্যবসায়ীরা চা বাগানের পাশাপাশি আনারস, লেবু ইত্যাদি কৃষিপণ্য উৎপাদনে আগ্রহী থাকলেও, বর্তমানে অনেকে কৃষিপণ্য উৎপাদনের ব্যবসা ছেড়ে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছেন। দ্রুত প্রসার ঘটছে এ খাতের। ফলে, কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ ও তাদের উপর নির্ভরশীল তাদের পরিবারের লাখো সদস্য।
অন্যান্য ব্যবসাও গড়ে উঠেছে পর্যটকদের ঘিরে। তাদের মূল ক্রেতা পর্যটকরাই। চায়ের জন্য বিখ্যাত শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে আসলে পর্যটকরা ফেরার পথে চা পাতাও কিনে নিয়ে যান।
আগে থেকে বেশ কিছু চা পাতার দোকান থাকলেও গত ২ বছরে তা বেড়েছে কয়েকগুণ। স্টেশন রোড, ভানুগাছ রোডসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সারিসারি চা পাতার দোকান। একটি উপজেলা শহরে এতগুলো চা পাতার দোকান মূলত পর্যটকদের জন্যই। এতো চা পাতার দোকান হলেও বিক্রি ভালোই হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
চা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ফাহিম এন্টারপ্রাইজের পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, শ্রীমঙ্গলে বৈধ এবং অবৈধ মিলে অন্তত ২শ’ চা পাতার দোকান রয়েছে। পর্যটকরাই এসব দোকানের মূল ক্রেতা। ২শ’ দোকানের ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক হাজার উপকারভোগী রয়েছেন। একটা সময় যারা ছোট ছোট বিভিন্ন ব্যবসা করতেন, তারাও এখন চা পাতার ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন।
এর বাইরে সব ধরনের ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন পর্যটকদের থেকে। শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এ এস এম ইয়াহিয়া জানান, আমাদের সমিতিতে নিবন্ধনকৃত ২ হাজারের বেশী ব্যবসায়ী আছেন। এদের সবাই কোন না কোনভাবে পর্যটন থেকে লাভবান হচ্ছেন। ক্রেতাদের সার্কেল বা স্থানীয় অর্থনীতির চাকা যেভাবে ঘুরছে তার চালিকা শক্তি পর্যটকরা। একজন পর্যটক যখন একজন রিক্সা চালককে ৫০ টাকা দেন সেই চালক সেখান থেকে ১০ টাকা খরচ করছে পাড়ার চায়ের দোকানে। সে হিসেবে এ অর্থনীতির অংশ উপজেলার প্রতিটি মানুষ।
নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী খাসিয়া সম্প্রদায়ের নেতা সাজু মারছিয়াং জানান, একসময় তার আয়ের উৎস ছিল পান চাষ। বর্তমানে তার ২টি জিপ রয়েছে- যেগুলো পর্যটক পরিবহন করে। তার মত তাদের সমাজের অনেকেই পর্যটন সংশ্লিস্ট ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
তিনি আরও জানান, কয়েকশ’ জিপ গাড়ি রয়েছে শ্রীমঙ্গলে। এসব জিপ একসময় লেবু, আনারসসহ বিভিন্ন কাঁচামাল পরিহনে ব্যবহৃত হতো। দিন শেষে আয় হতো ৫০০-৬০০ টাকা। কিন্তু, বর্তমানে এসব জিপের বড় একটি অংশ পর্যটক নিয়ে ঘুরে। ফলে, বেড়েছে আয়। বর্তমানে তারা দিনে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা আয় করতে পারেন। এছাড়া প্রাইভেটকার-সিএনজিচালিত আটোরিকশাও এখন পর্যটকদের উপর নির্ভরশীল। কর্মসংস্থান হয়েছে শত শত চালকের।
চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল শহরে এখন পা বাড়ালেই দেখা মিলে অনেক রেস্টুরেন্টের। এসব রেস্টুরেন্টের বেশীর ভাগই পর্যটকদের উপর নির্ভরশীল।
এসবের বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে তরুণ-তরুনীরাও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন পর্যটন থেকে। বাইরের অতিথিরা শ্রীমঙ্গল আসার আগেই এদের মাধ্যমে হোটেল-রিসোর্ট বুকিং দিচ্ছেন। ডিজিটাল মার্কেটিং করে তারা আয়ের পথ পেয়েছেন।
শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার আহ্বায়ক আবু সিদ্দিক মুসা জানান, শ্রীমঙ্গলে ৭৫টি হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে। এর মধ্যে কারো কারো শতাধিক কর্মচারী রয়েছে। আমাদের রিসোর্টে রয়েছে ২৯ জন। আনুমানিক ১ হাজার মানুষ শুধু রিসোর্টেই কাজ করে। পর্যটকদের কারণে একটি ছোট পানের দোকান থেকে সিএনজি অটোরিকশা চালক সবাই লাভবান হচ্ছে। আবার, যখন এ সিএনজিটা মেরামত হচ্ছে সেটার যে যন্ত্রাংশ ক্রয় করছে বা মেরামত করছে সেওতো লাভবান হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গাড়ি চালকসহ সব মিলিয়ে পর্যটনের কারণে সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে আনুমানিক ১০ হাজার মানুষের। এদের সবার পরিবার রয়েছে।
পর্যটক কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে কতো টাকা লেনদেন হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন পর্যটক ২ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ করেন। বছরে অন্তত ৪ লাখ পর্যটক আসেন। শ্রীমঙ্গলে ৫০০ টাকায় থাকা যায় এমন হোটেলের পাশাপাশি তারকা হোটেলও রয়েছে। সব মিলিয়ে কয়েকশ কোটি টাকা এ খাত থেকেই শ্রীমঙ্গলের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।
শ্রীমঙ্গলের ইউএনও নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা একটি জরিপ করেছিলাম। তাতে প্রতিদিন আশেপাশের এলাকা এবং দূরদূরান্ত থেকে অন্তত ৫ হাজার পর্যটক শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে আসার তথ্য পেয়েছি। এসব পর্যটকদের উপর নির্ভরশীল শ্রীমঙ্গলের অর্থনীতি। যদি কোন কারণে ৬ মাস পর্যটক এখানে না আসে তাহলে শতকরা ৪০ ভাগ কৃষিপণ্য অবিক্রিত থাকবে। লেবু, আনারস, চাপাতাসহ বিভিন্ন কৃষিপন্যের শতকরা ৪০ ভাগ সরাসরি পর্যটকরা ক্রয় করেন। পর্যটকদের কারণে সরাসরি প্রায় ১৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। যার সুবিধাভোগী তাদের পরিবার ও প্রতিবেশী কয়েকলাখ মানুষ। চা পাতার দোকান, মনিপুরি হস্ত শিল্পসহ অনেক ব্যবসা আছে যার শতকরা ৯৯ ভাগ গ্রাহক পর্যটকরা।
তিনি আরও বলেন, এখন আমাদের প্ল্যান পর্যটনের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন। পর্যটকরা যেনো সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করতে পারেন- যাতে কোন মধ্যসত্ত্বভোগী না থাকে। আমরা সে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। ২০৩০ সালের মধ্যে শ্রীমঙ্গলে পর্যটক বর্তমানের ৩ গুণ বৃদ্ধির জন্য আমরা কাজ করছি।
আমাদের যে পরিকল্পনা রয়েছে তাতে নৃ-ত্বাত্তিকগোষ্টীর বিভিন্ন পন্য সরাসরি পর্যটকদের হাতে যাবে- যা তাদেরকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেবে। যদিও এখনই তারা বিভিন্নভাবে সুবিধা পাচ্ছেন তবু আমরা সে ক্ষেত্রটা আরেকটু বড় করতে চাইছি, বলেন ইউএনও।