বাংলাদেশে ফিস্টুলা পরিস্থিতি : বছরে যুক্ত হচ্ছেন দুই হাজার নতুন রোগী

বাংলাদেশে ফিস্টুলা পরিস্থিতি : বছরে যুক্ত হচ্ছেন দুই হাজার নতুন রোগী

শ. ই. সরকার জবলু :: বাংলাদেশে প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীর তালিকায় প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছেন দুই হাজার নতুন রোগী। প্রসবজনিত ফিস্টুলা একটি ষ্পর্শকাতর নারী স্বাস্থ্য সমস্যা। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রসবজনিত ফিস্টুলার সংখ্যা কমলেও, এখনো দেশ সম্পূর্ণভাবে ফিস্টুলামুক্ত হয়নি। বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল ও সকল মহিলাজনিত ফিস্টুলা রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর।
সারাবিশ্বেই প্রসবকালীন ফিস্টুলা রোগ সমস্যা বিরাজমান। তাই, প্রসবকালীন ফিস্টুলা রোগের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে জাতিসংঘ ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিকভাবে প্রসবকালীন ফিস্টুলা নির্মূল দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই প্রেক্ষিতে প্রতিবছর ২৩ মে বিশ্বব্যাপী প্রসবকালীন ফিস্টুলা নির্মূল দিবস পালিত হচ্ছে।
বিশ্বে এখন প্রায় ১০ লাখ নারী ফিস্টুলা রোগে ভুগছেন। তার মধ্যে বাংলাদেশে ভূগছেন প্রায় ২০ হাজার নারী। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার নতুন রোগী যোগ হচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর এ তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন প্রায় দুই হাজার নতুন রোগী। এ পরিস্থিতিতে সামাজিক সচেনতনতা বৃদ্ধি, বাল্যবিবাহ রোধ ও কম বয়সে গর্ভধারণ নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি নিরাপদ প্রসবের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতে ‘ফিস্টুলা নির্মূলকরণ কার্যক্রম-২০৩০’ বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ কার্যক্রমের আওতায় প্রধানত ফিস্টুলা রোগী শনাক্তকরণ, রেফারের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং পুনর্বাসনের আওতাভুক্ত করতে সহায়তা করা হয়।
সিআইপিআরবি সূত্রে জানা যায়- সিলেট বিভাগে গত ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বছরে ফিস্টুলা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে ৩৭৭ জন। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯৭ জন, সিলেটে ৫১ জন, হবিগঞ্জে ১২১জন এবং সুনামগঞ্জে ১০৮ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। ৩৭৯ জন রোগী শনাক্ত করে ৩৩০ জনকে সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। ২৭৬ জনের অপারেশন হয়েছে এবং ২০৫ জন সুস্থ্য হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে পেয়েছেন। এছাড়া, ১৫২ জনকে বিভিন্ন সহায়তা (যেমন- সেলাই মেশিন, ছাগল, নগদ টাকা, খাদ্য-সামগ্রী, ভিজিডি কার্ডসহ বিভিন্ন ধরনের সরকারী ভাতা) দিয়ে পুণর্বাসনে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন- বাংলাদেশে ফিস্টুলা হবার অনেক কারণের মধ্যে বাল্য বিবাহ, কুসংস্কার, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, ন্যূনতম যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করা অন্যতম। বিশেষকরে হাওরাঞ্চল ও চা-বাগানের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে এর প্রবণতা বেশি।
সিআইপিআরবি’র প্রকল্প সমন্বয়কারী মোঃ আলতাফুর রহমান জানান- ফিস্টুলা প্রতিরোধের উপায় হলো বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, কম বয়সে বাচ্চা না নেয়া এবং হাসপাতালে প্রসব করানো। সিলেট বিভাগের চা-জনগোষ্ঠীর মধ্যে অধিক সংখ্যক ফিস্টুলা রোগী থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়। কারণ, এ পর্যন্ত ৪২ জন রোগী চা বাগান এলাকা থেকে সনাক্ত করা হয়েছে। তাই, চা-বাগান এলাকায় অধিক পরিমাণে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সিআইপিআরবি’র সহায়তায় প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসা বিনামূল্যে করে দেয়া হয়। এখনো দরিদ্র রোগীদের জন্য চিকিৎসাসহ যাবতীয় খরচ, এমনকি যাতায়াত ভাড়াও সহায়তা হিসেবে দেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।
বছর দশেক ধরে রাজঘাটের আকল মনি পট নায়েক ফিস্টুলা রোগে ভূগছিলেন। তার ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়। বিয়ের পরের বছর প্রথম বাচ্চা বাড়িতে জন্মের পর মারা যায়। একবছর পর দ্বিতীয় প্রসবেও বাড়িতে মৃত বাচ্চা জন্ম হয়। তারপরের বছর তৃতীয় প্রসবের সময় সারারাত বাধাগ্রস্ত প্রসব ব্যথায় ভূগে স্থানীয় বাগান হাসপাতাল হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আশংকাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয়। প্রসব জটিলতার জন্য তাকে সেখান থেকে আবার জেলা সদর হাসপাতাল হয়ে এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে পরের দিন সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে মৃত বাচ্চা প্রসব করানো হয়। ওইসময় তার ফিস্টুলা শুরু হয়।
খেজুরীছড়া চা বাগানের মালতি রিকিয়াসনকে ১৬ বছর বয়সে বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয়। আর, এ বাল্যবিবাহ ও ঘন ঘন গর্ভধারণই তাকে ফিস্টুলাতে আক্রান্ত হতে সহায়তা করে। বার বার বিলম্বিত প্রসব ও বাধাগ্রস্ত প্রসবের শিকার হওয়া সত্ত্বেও, ৩ বারই বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রী দ্বারা মালতির প্রসবের চেষ্টা করা হয়। ৩য় প্রসবের সময় ৪৮ ঘন্টা বাড়িতে বিলম্বিত প্রসব জটিলতায় ভোগার পর তাকে এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে মৃত বাচ্চা প্রসব করানো হয়। তখন থেকে তিনি ফিস্টুলায় ভূগতে থাকেন। এমতাবস্থায়, তালাকপ্রাপ্তা হয়ে তিনি জীবনে বেঁচে থাকার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। আকলমনি ও মালতি এখন পুরোপুরি সুস্থ্য। তাদের স্বাভাবিক জীবন লাভে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে সিআইপিআরবি। এরকম শতাধিক মায়ের জীবন রক্ষার্থে সিআইপিআরবি সিলেট বিভাগে অবদান রাখছে।
প্রসঙ্গত- নারী জননাঙ্গে ফিস্টুলার লক্ষণ ও শনাক্তের সহজ উপায় হচ্ছে রোগীর সবসময় প্রস্রাব বা পায়খানা অথবা উভয়ই ঝরতে থাকবে। সেক্ষেত্রে প্রস্রাব বা পায়খানার সময় রোগীর কোনো চাপ বা বেগ অনুভব হবেনা। সব সময় কাপড় ভেজা থাকবে। এ সমস্যা শুরু হবে সন্তান প্রসবের পর কিংবা তলপেট বা জরায়ুতে কোনো অপারেশনের পর। অর্থাৎ ফিস্টুলা হচ্ছে মূত্রথলি অথবা মলাশয়ে এক বা একাধিক অস্বাভাবিক ছিদ্র হয়ে মাসিকের রাস্তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া। ফলে, মাসিকের রাস্তা দিয়ে সব সময় প্রস্রাব বা পায়খানা অথবা উভয়ই ঝরতে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *