শ. ই. সরকার জবলু :: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সিলেট বিভাগের ৩ জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে নির্বাচনী খেলা জমলেও উল্টো দশা অপর জেলা মৌলভীবাজারে। এবার মৌলভীবাজার জেলার ৪টি আসনের মধ্যে ১, ৩ ও ৪ আসনের এমন নিস্তরঙ্গ দশা ইতিপূর্বে কখনও দৃশ্যমান হয়নি। যোগ্য প্রার্থীর অভাবের কারণেই হয়তো এমন দৈন্যদশা। এ কারণ ছাড়াও একটি পক্ষ ধারণা করছেন বা ভাবছেন, তাদের ভোট বর্জনের আহবাণে জনগণ ভোটকেন্দ্রমুখী হবেনা। তবে, হালহকিকতে মনে হচ্ছে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হলে সচেতন ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। তবে, মৌলভীবাজার- ২ (কুলাউড়া) আসনে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। এখানে খেলা জমে উঠেছে আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে। সবার নজর এখন সেদিকেই।
পর্যটন এলাকা, প্রবাসী অধ্যুষিত ও দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ খ্যাত মৌলভীবাজার জেলার ৪টি আসনেই স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় সব নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থীরা ভালো ফলাফল করেছেন। এবারেও এর ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয়না। তবে, নির্বাচনকে কেন্দ্র কোথায়ও নির্বাচনী কোন আমেজ-উত্তাপ নেই বললেই চলে। তেমন গুঞ্জন নেই ভোটারদের মাঝে। এবারে জেলার ৪টি আসনের দু’টিতে আওয়ামীলীগের পুরনো প্রার্থী এবং দুটিতে নতুন প্রার্থী। প্রায় সব আসনেই নৌকার প্রার্থীরা অনেকটা নির্ভার।
মৌলভীবাজার- ১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসনে আওয়ামীলীগ প্রার্থী মোঃ শাহাব উদ্দিন নির্ভার হলেও ভেতরে ভেতরে রয়েছেন অজানা আতঙ্কে। এ আতঙ্কের কারণ হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের ভোট ব্যাংক। এখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে, যদি বিএনপি-জামায়াত ভোট দিতে যায় তাহলে নিরব বিপ্লব ঘটে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ আসনে ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালের (সিলেট-১২ বড়লেখা) নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম (নেীকা), ১৯৮৬ সালের (মৌলভীবাজার- ১ বড়লেখা) নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থী ইমান উদ্দিন (নৌকা), ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এবাদুর রহমান চৌধুরী (লাঙ্গল), ১৯৯১, ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী এবাদুর রহমান চৌধুরী (ধানের শীষ), ১৯৯৬ (মৌলভীবাজার- ১ বড়লেখা), ২০০৮ (মৌলভীবাজার- ১ বড়লেখা-জুড়ী), ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থী মোঃ শাহাব উদ্দিন (নৌকা) সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে এবাদুর রহমান চৌধুরী সাংসদ নির্বাচিত হয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেও মাঝপথে তাঁকে প্রতিমন্ত্রীত্ব থেকে বাদ দেয়া হয়। ২০১৪ সালে মোঃ শাহাব উদ্দিন সাংসদ হয়ে জাতীয় সংসদের হুইপ-এর দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১৮ সাল থেকে এখনও পরিবেশ, বন ও জলবায়ূ পরিবর্তনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আসন্ন নির্বাচনে এ আসনে তার সাথে প্রতিদ্বন্ধীতা করছেন জাতীয় পার্টি প্রার্থী আহমদ রিয়াজ উদ্দিন (লাঙল), তৃণমূল বিএনপি প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (সোনালী আঁশ) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ময়নুল ইসলাম (ট্রাক)। ১টি পৌরসভা ও ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ১৫ হাজার ৬৩৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৬০ হাজার ১৬১ জন আর নারী ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৭৭ জন। তৃতীয় লিঙ্গের আছেন ১ জন।
মৌলভীবাজার- ২ (কুলাউড়া) আসনের জনগণ বিগত ১৫ বছর যাবৎ উন্নয়ন থেকে অনেকটা বঞ্চিত। কারণ, গত ২০ বছর ধরে এ আসন থেকে আওয়ামীলীগের কেউ নির্বাচিত হতে পারেননি। এ আসনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এর সাথে প্রতিদ্বন্ধীতা করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামীলীগের সিনিঃ সহ-সভাপতি ও কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম সফি আহমদ সলমান ও সাবেক সাংসদ মো. আব্দুল মতিন এবং তৃণমূল বিএনপি’র প্রার্থী দুইবারের সাবেক সাংসদ এমএম শাহীন। এ তিনজনই শক্ত প্রতিদ্বন্ধী। কারণ তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব ভোটব্যাংক। সার্বিক পরিস্থিতি ভিত্তিতে বলা যায়, কে হারবে, কে জিতবে, কেহ আগাম বলতে না পারবে। ১টি পৌরসভা ও ১৭টি ইউনিয়ন ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ সংসদীয় আসনে মোট ভোটার ২ লাখ ৪১ হাজার ১৬১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ২২ হাজার ৪২২ জন। নারী ভোটার ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৩৯ জন।
মৌলভীবাজার- ৩ (সদর-রাজনগর) আসনটি আওয়ামীলীগের দুর্গ এবং জেলার চারটি আসনের মধ্যে ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত। এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম এম. সাইফুর রহমান বিএনপি সরকারের শাসনামলে একাধিকবার অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে মরহুম সৈয়দ মহসিন আলী সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ আসনে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় সব নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থীরা ভালো ফলাফল করেছেন। তবে, দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামীলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের প্রভাব পড়তে পারে এবারের নির্বাচনে। প্রথমবারের মতো নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পেয়ে চমক দেখান জেলার রাজনীতিতে নতুন মুখ শিল্পপতি মোঃ জিল্লুর রহমান। এ কারণে আবারও দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে জেলা আওয়ামীলীগ। নৌকার মাঝি জিল্লুর রহমানের সাথে রয়েছেন প্রয়াত সমাজ কল্যাণমন্ত্রী ও দুইবারের সাবেক সাংসদ সৈয়দ মহসীন আলীর পরিবারসহ তার গ্রুপ। এখানে শক্ত কোন প্রতিদ্বন্ধী না থাকায় নৌকার বিজয় নিশ্চিতই বলা যায়। ১টি পৌরসভা ও ২০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৩১ হাজার ৮৪২ জন, আর নারী ২ লাখ ২৪ হাজার ৫৪৭ জন। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৩ জন।
মৌলভীবাজার- ৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনে প্রার্থী রয়েছেন আওয়ামীলীগের গত ৬ বারের সাংসদ আব্দুস শহীদ, জাপার মো. মস্তান মিয়া, ইসলামি ঐক্যজোটের মো. আনোয়ার হোসাইন, ইসলামি ফ্রন্টের আব্দুল মুহিদ হাসানী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. নজরুল ইসলাম। এখানেও শক্ত কোন প্রতিদ্বন্ধী না থাকায় নৌকার বিজয় নিশ্চিতই বলা যায়। ২টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৫৯ হাজার ১০৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৩১ হাজার ৩১০ জন। আর নারী ২ লাখ ২৭ হাজার ৭৯৩ জন। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ১ জন।