শ. ই. সরকার জবলু :: মৌলভীবাজারে প্লাজমা ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারের বিরুদ্ধে নোমান রাজার আনীত ভুল রিপোর্টের অভিযোগ মিথ্যা বলা যায়না। গত ৩ আগস্ট মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শহরের দরগা মহল্লার বাসিন্দা মোঃ নোমান রাজা অভিযোগ করেছিলেন- গত ১৫ জুলাই তার অসুন্থ্য মেয়েকে দি প্লাজমা ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারে ডাঃ ইসমাত জাহানকে দেখান। তিনি প্রথমেই প্লাজমা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে কিছু পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট দেখে রোগীর থাইরয়েড রোগ হয়েছে এবং একনাগাড়ে ৩ মাস ঔষধ সেবন করতে হবে জানিয়ে চিকিৎসাপত্র দেন। ঔষধ সেবন শুরুর ৩ দিনেই মেয়ের অবস্থার চরম অবনতি হওয়ায়, তিনি আতংকিত হয়ে ২২ জুলাই মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় গিয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. মীর মোশাররফ হোসেনকে দেখান।
তিনি পপুলার ডায়গনস্টিক সেন্টারে কিছু পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট দেখে জানান- রোগীর থাইরয়েডের কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি। তিনি ব্যবস্থাপত্রে কোন ঔষধ না লিখে “থাইরয়েডের ঔষধ খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই” লিখে দেন এবং ডাঃ ইসমাত জাহানের ব্যবস্থাপত্রে লিখিত ঔষধ খাওয়াতে নিষেধ করেন। এরপর তিনি রোগীকে নিয়ে মৌলভীবাজারে ফিরে আসেন এবং ঔষধ ছাড়াই রোগী সুস্থ্য হয়। ফলে, তিনি প্লাজমা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের রিপোর্ট ভূয়া বা ভুল বলে উল্লেখ করেছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনের পর দি প্লাজমা ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারের পরিচালক মনসুর আহমদ গণমাধ্যম কর্মীদেরকে জানিয়েছিলেন- ভূয়া রিপোর্টের অভিযোগ ভিত্তিহীন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞরা বলতে পারবেন রিপোর্ট ভূয়া না সঠিক।
ডাঃ ইসমাত জাহান জানিয়েছিলেন- থাইরক্স ঔষধে সমস্যা হবার কথা নয়। রোগীর অন্য কোন সমস্যার কারণে এটা হতে পারে। সমস্যা দেখা দেয়ার পর রোগী আবার আমার কাছে আসলে বুঝতে পারতাম কি কারণে সমস্যা হয়েছে।
ওইসময় ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথপোকথনে প্লাজমা ডায়াগনষ্টিক এমডি কেএম রুবেল আহমদ বলেছিলেন- আমাদের ২টা রিপোর্টই নরমাল আছে, কোথায়ও ভুল নাই। শুধু হাইপোথাইরয়েড আমার রিপোর্টে ৭ আসছে- যেখানে ৬ পর্যন্ত নরমাল। বর্ডার লাইনে আছে থাইরয়েড। এটা রোগীর আছে। হরমোন প্রতি মুহূর্তে চেঞ্জ হয়- যা আমাদের শরীরের যাবতীয় অর্গান ব্যালেন্স করে। একজন রোগীর একটা টেস্ট ১০টা প্রতিষ্ঠানে একই সময়ে করালেও ১০ রকম রিপোর্ট আসবে। এটাই স্বাভাবিক, এটাই মেডিক্যাল টেস্টের নিয়ম। তিনি চ্যালেঞ্জ করে বলেন- যদি কোনো একজন ডাক্তার আমার রিপোর্ট এবনরমাল বলেন, তাহলে যে শাস্তি দিবেন আমি মাথা পেতে নেবো।
ভুক্তভোগী লোকটা যদি শিক্ষিত হতো, তাহলে সে রিপোর্ট ভুল বলতোনা। দ্বিতীয়ত রোগীর অবস্থা খারাপ হলে সে ডাক্তারের কাছে কৈফিয়ত চাইত। তৃতীয়ত প্রতিষ্ঠানের কাছে জবাবদিহি চাইত। উনি এসবের কিছুই না করে ফেইসবুকে প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন। সাংবাদিককে বলবেন এটা স্বাভাবিক। আমিও কোনো অনিয়মের শিকার হলে সাংবাদিকের কাছে যাবো। কিন্তু, সাংবাদিকেরও দায়িত্ব আছে আমার অভিযোগ যাচাই করার। আমরা এ রিপোর্ট শহরের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দেখিয়েছি। সবাই রিপোর্ট নিয়ে ভুল হবার অবকাশ নেই বলে জানিয়েছেন। আমি বিনয়ের সাথে বলবো, আমার রিপোর্টের সত্যতা যাচাই করুন।
পরবর্তীতে তিনি এ প্রতিনিধির ভিডিওধারণকৃত বক্তব্যে বলেছেন- আমাদের ও ঢাকার রিপোর্ট একই। জনৈক ভদ্রলোক কোন ব্যক্তি বা কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্ররোচনায় আসক্ত হয়ে আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ও আমার রিপোর্টের বিরুদ্ধে ভুয়া মনগড়া প্রচারমূলক বক্তব্য প্রচার করেছেন ও প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছেন। আমার প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্ন ও নষ্ট করার জন্য এ ভিডিও প্রচার করায় আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা মনে করি ভুক্তভোগী কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠানের দূর্নাম করার জন্য প্রেস কনফারেন্স করেছেন।
ল্যাব টেকনোলজিস্ট সোমা সিনহা বলেছেন- এখানে নমুনা টেস্টের সব কিছু অটো মেশিনে করা হয়। আমরা শুধু সিরাম দেই, সিলেক্ট করা হয়, তারপর মেশিন রেজাল্ট দিয়ে দেয়। হাতে কোন কাজ নাই, শুধুমাত্র আমি আইডি নাম্বার একুরেট ভালোভাবে বসাতে হয়। আমার কোন ভুল নেই। সেম্পুলের সবকিছু নরমাল রেঞ্জের ভেতরে ছিল। রিপোর্টে তো কোন প্রবলেম দেখছি না।
ডাঃ ইসমাত জাহান বলেছেন- ঢাকার ডাক্তার স্যারের প্রেসক্রিপশনটা দেখলাম, স্যারও কিন্তু আমার ডায়াগনসিসের সাথে এগ্রি করে সাবক্লিনিকাল হাইপোথাইরয়েডিজম লিখেছেন। স্যার যে রোগির প্রবলেম ডকুমেন্টস করে রাখছেন, এখানে কোথাও লেখা নাই যে রোগির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। রোগির সবকিছু নরমাল। কাজেই, কোথায় ওনার সমস্যা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারলাম না। যেকোনো ঔষধ খাবার পর রোগির সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওনারা যদি আমার কাছে আসতেন আমি হয়তো তাদেরকে হেল্প করতে পারতাম। আর, তাদের হয়তো ঢাকার কষ্ট না করলেই হত।
সিভিল সার্জন ডাঃ চৌধুরী জালাল উদ্দীন মোরশেদ বলেছেন- অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের সাথে মৌলভীবাজার জেলায় যে চিকিৎসা নিয়েছেন সেটার চিকিৎসা পত্রটা পাইনি। উনাকে আমরা পত্র দিব যে, মৌলভীবাজার জেলায় যে চিকিৎসা নিয়েছেন ওই চিকিৎসা পত্রটা অভিযোগের সাথে সংযুক্ত করে দিতে। পরবর্তীতে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করে ওনাকেও ডাকব। আমাদের পদ্ধতি মোতাবেক আমরা আগাবো। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ল্যাবে কোন ভুল হয়েছে কিনা সেটাও আমরা দেখবো এবং প্রয়োজনে অটো মেশিন পরীক্ষা করা হবে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাবার আগ পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছেনা।
ভূক্তভোগী নোমান রাজা বলেছেন- ডাঃ ইসমাত জাহান প্লাজমা ডায়াগনষ্টিকের রিপোর্ট দেখে রোগীর থাইরয়েড হয়েছে জানিয়ে চিকিৎসাপত্র দিলেন। ৩ দিন ঔষধ সেবনে রোগী মারাত্নক অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। এতে আতংকিত হয়ে আমি রোগীকে ঢাকায় নিয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. মীর মোশাররফ হোসেনকে দেখালে, তিনি পপুলার ডায়াগনষ্টিকে কিছু টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট দেখে জানান- রোগীর থাইরয়েডের সমস্যা নেই। তিনি ব্যবস্থাপত্রে কোন ঔষধ না লিখে “থাইরয়েডের ঔষধ খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই” লিখে দেন এবং ডাঃ ইসমাত জাহানের চিকিৎপত্রের ঔষধ খাওয়াতে নিষেধ করেন। রোগীও ঔষধ ছাড়াই সুস্থ্য হয়।
ফলে, আমি নিশ্চিত হয়েছি- প্লাজমা ডায়াগনষ্টিকের রিপোর্ট ভুল ছিল অথবা রিপোর্ট ঠিক আছে, ডাক্তারের ভুল হয়েছে। কারও না কারও ভুলের কারণেই রোগী মারাত্নক অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলো। তা নাহলে এরকম হবার কথা নয়। সমাজের সচেতন নাগরিক হিসাবে আমি এর প্রতিবাদ করায় প্লাজমা ডায়াগনষ্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ আমাকে অশিক্ষিত, পাগল, চাঁদাবাজ ইত্যাদি নানা অপবাদ এমনকি মামলা দায়েরের হুমকীও দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমার অনুরোধ- তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন- যাতেকরে আমি যেভাবে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছি সেভাবে যেন আর কেহ বিড়ম্বনার শিকার হতে না হয়।
পর্যবেক্ষণ করে প্লাজমা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের ডায়াগনসিস রিপোর্টে দেখা যায়- ফ্রি টি ফোর, টিএসএইচ, ইউথাইরয়েড ও হাইপারথাইরয়েডের রেফারেন্স ভ্যালু নরমাল। কিন্তু, হাইপোথাইরয়েডের রেফারেন্স ভ্যালু ৭.০- যা ৬.০ পর্যন্ত নরমাল। এর মানে হাইপোথাইরয়েড এবনরমাল।
এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে- ডাঃ ইসমাত জাহান এ রিপোর্টের ভিত্তিতেই থাইরয়েডের চিকিৎসাপত্র দেয়ায় রোগীর অবস্থার গুরুতর অবনতি হয়। তাছাড়া, প্লাজমা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের এমডি কেএম রুবেল আহমদের বক্তব্য থেকেও এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এতেকরে, ভুল রিপোর্টের কারণে রোগীর অবস্থার গুরুতর অবনতি হয়েছে বলে নোমান রাজা কেন, যে কারোরই ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, ডাক্তাররা ডায়াগনসিস রিপোর্টের ভিত্তিতেই চিকিৎসাপত্র দিয়ে থাকেন। তাই, সার্বিক বিবেচনায় প্লাজমা ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারের বিরুদ্ধে নোমান রাজার আনীত ভুল রিপোর্টের অভিযোগ মিথ্যা নয় বলেই প্রতীয়মান।