বৃষ্টিপাত ও ঢলে সুনামগঞ্জের হাওড় ও নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হতে চলেছে জনবসতি এলাকা

বৃষ্টিপাত ও ঢলে সুনামগঞ্জের হাওড় ও নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হতে চলেছে জনবসতি এলাকা

সুরমার ঢেউ সংবাদ :: বৃষ্টিপাত ও ঢলে সুনামগঞ্জের হাওড় ও নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হতে চলেছে জনবসতি এলাকা। ঢলের পানিতে ডুবে গেছে মানুষের চলাচলের সড়ক। অব্যাহত বৃষ্টিতে পানি বাড়ছে নিম্নাঞ্চলে। জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা সদর বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, মধ্যনগর দোয়ারাবাজার ও ছাতকের নিম্নাঞ্চলে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবল বেগে নেমে আসছে। বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে পানি বেড়েছে সুরমা যাদুকাটা বৌলাই চেলা খাসিয়ামারা সোমেশ্বরী, চলতি ঝালোখালী রক্তি ও মনাই পাটলাই নদীর পানি।
মেঘালয় পাহাড়ের ৩০টির মতো পাহাড়ি ছড়া দিয়ে ঢলের পানি প্রবেশ করছে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। এতে তলিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়কসহ বিভিন্ন নিচু এলাকা। জেলার সীমান্তের বংশীকুণ্ডা উত্তর, বংশীকুণ্ডা দক্ষিণ, উত্তর শ্রীপুর, উত্তর বড়দল, বাদাঘাট, বাদাঘাট দক্ষিণ, সুরমা, জাহাঙ্গীরনগর, ইসলামপুর, কালারুকা, বোগলা নরসিংপুরসহ ১০টি সীমান্তবর্তী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের পাহাড়ি নদী দিয়ে উজানের ঢল প্রবাহিত হচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকার সড়কে হাঁটুপানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। এ ছাড়া সকাল থেকে ভারি বৃষ্টিপাতে সুনামগঞ্জের জনজীবন স্থবির হয়ে আছে। বৃষ্টিপাতের কারণে এবার ঈদুল আজহার ছুটিও উপভোগ করা হয়নি এ অঞ্চলের মানুষের। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতেও দর্শনার্থীর উপস্থিতি কম ছিল।
গতকালের আগের ৭২ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৪১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ জুলাই শনিবার দুপুর ১২টায় গত ২৪ ঘণ্টার রেকর্ডে ১৪৫, শুক্রবারের আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৫০ এবং বৃহস্পতিবারের আগের ২৪ ঘণ্টায় ১১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। একই সময়ে সুনামগঞ্জের লাগোয়া ভারতের চেরাপুঞ্জিতে তিনদিনে বৃষ্টি হয়েছে ৫২৩ মিলিমিটার। অর্থাৎ শনিবার ২৪ ঘণ্টায় ২২০, শুক্রবার দুপুরে এর আগের ২৪ ঘণ্টার ১৩১ মিলিমিটার এবং বৃহস্পতিবার দুপুরে এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
তবে, জেলায় আগাম বন্যা না হওয়ায় গত ২০ দিনের টানা বর্ষণেও বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কিন্তু, সীমান্তবর্তী এলাকার সড়ক ও জনবসতিতে ভোগান্তি তৈরি হয়েছে। জেলার চারটি গুরুত্বপূর্ণ পানির উচ্চতা পরিমাপ যন্ত্রের পয়েন্টের মধ্যে কেবল ছাতক ছাড়া আর কোথাও বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি। তবে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে (ভারতের চেরাপুঞ্জিতে) ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে জেলার ছাতক পয়েন্টে পানি বেড়েছে ০.২৩ সেন্টিমিটার। বর্তমানে বিপৎসীমার ০.৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে অর্থাৎ ৮.৮০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে সুরমার পানি। সুনামগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার শূন্য দশমিক ০.২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে অর্থাৎ ৭ দশমিক ৫২ সেন্টিমিটার উচ্চতায় সুরমা পানি প্রবাহিত হচ্ছে। দিরাই উপজেলার পুরাতন সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ০ দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার নিচে এবং পাহাড়ি নদী যাদুকাটার পানি বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শক্তিয়ারখলা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১ দশমিক ৫২ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে।
এদিকে, পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণে সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার সোমেশ্বরী, উব্দাখালী, মনাই নদী ও হাওরের পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপজেলার সদর, চামরদানী, বংশীকুণ্ডা দক্ষিণ ও বংশীকুণ্ডা উত্তর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল ও মধ্যনগর-মহিষখলা সড়কের নিচু অংশ তলিয়ে গেছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এ সময় এ অঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, সারিগোয়াইন, সোমেশ্বরি পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার কিছু নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় মুষলধারে বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বংশীকুণ্ডা উত্তর ইউনিয়নের মহিষখলা-বাঙালভিটা সড়কের বিভিন্ন স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। চলাচল করতে অসুবিধা হচ্ছে। অব্যাহত বৃষ্টিপাত ও ঢলে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। পাহাড়ি ছড়াগুলোর মধ্যে- মহিষখলা ছড়া, রূপনগর ছড়া, বাঙালভিটা ছড়া এবং ওলাছড়া থেকে ব্যাপক ঢল নামছে। তাতে সড়কের মাটি ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঢলের পানি। গুড়গাঁও থেকে মহিষখলা পর্যন্ত পাকা সড়কে এখন হাঁটুপানি। এভাবে ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
এদিকে, লাগাতার বৃষ্টি থাকায় ঈদের লম্বা ছুটিতেও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরসহ পর্যটন এলাকায় পর্যটকের উপস্থিতি অন্য যেকোনো বড় ছুটির চেয়ে কম ছিল। লাগাতার ভারি বর্ষণ থাকায় টাঙ্গুয়ার হাওড়সহ তাহিরপুরের পর্যটন এলাকায় পর্যটকের উপস্থিতি কম ছিল। এর মধ্যেও যারা এসেছিলেন, তাদের অনেকেই হাওড়ের ভেতরে যাননি। হাওরে ঢেউ থাকায় আশপাশের এলাকাতেই সময় কাটিয়েছেন তারা।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, সুনামগঞ্জ ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত বেড়েছে। ছাতক পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ০.৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
উল্লেখ্য, এর আগে ১৪ জুন থেকে ২২ জুন পর্যন্ত সুনামগঞ্জে টানা বৃষ্টিপাত হয়েছে। ২৩ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত জেলায় তেমন বৃষ্টিপাত হয়নি। রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া বিরাজ করছিল। ২৮ জুন থেকে আবারও বাড়তে থাকে বৃষ্টিপাত। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, গত এক মাসে (জুন) সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৩১৬.০০ মি.মি., যা সারাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, উজানের ঢল ও বৃষ্টিপাতে সুনামগঞ্জে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *