মৌলভীবাজারে আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাথাগোঁজার ঠাই চান ভাগ্যাহত মিনারা

মৌলভীবাজারে আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাথাগোঁজার ঠাই চান ভাগ্যাহত মিনারা

বিশেষ প্রতিনিধি :: আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাথাগোঁজার ঠাই চান ভাগ্যাহত মিনারা। পুরো নাম মিনারা বেগম। বয়স ৫০ বছর। পেশায় শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি কাঁচামাল বিক্রেতা। অধিকাংশ দিন তার কাঁচামালের ভাসমান দোকানটি মৌলভীবাজার শহরের মৌলভীবাজার-সিলেট সড়কের হিলালপুরস্থ বাহারমর্দান রাস্তার মুখে দেখা যায়। শহরের কুসুমবাগ এলাকার এসআর প্লাজার সামনেও দেখা যায় মাঝেমধ্যে। কখনো তরিতরকারি, কখনো শাকসবজি, কখনো মৌসুমী ফলমূল বিক্রি করেন তিনি। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যতক্ষণ রাস্তায় লোক চলাচল থাকে ততক্ষণই তার কাঁচামালের ভাসমান দোকানটি খোলা রাখেন। এ থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে তার ৭ সদস্যের পরিবার।
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার উত্তর নরপতি এলাকার এশ্বাদ উল্যার কন্যা মিনারা বেগমের বিয়ে হয়েছিলো ১৯৭৫ সালে মৌলভীবাজার শহরের গোবিন্দশ্রী এলাকার ফজিল মিয়ার সাথে। বিয়ের কিছুদিন পর ক্যান্সারাক্রান্ত হয়ে স্বামী ফজিল মিয়া মারা গেলে, স্বামীর বাড়ির লোকজন মিনারাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। এসময় পরিচয় এবং পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজার এলাকার হারুনুর রশীদের সাথে। এ প্রেম একসময় শরিয়তসম্মতভাবে বিয়েতে গড়ায়। কিন্তু, মিনারার বিধি বাম! দাম্পত্য জীবনে ৩ পুত্র ও ১ কন্যা জন্মের পর ২০০৭ সালে হারুনুর রশীদও মারা যান। এরপর হারুনুর রশীদের বাড়ীর লোকজনও ৪ শিশুসন্তানসহ মিনারাকে তাড়িয়ে দেয়। এসময় মিনারা ৪ শিশুসন্তান নিয়ে চলে আসেন মৌলভীবাজার শহরে। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে কোনরকমে ভাড়াবাড়ীতে থেকে ৪ শিশুসন্তানকে লালন-পালণ করতে থাকেন। একসময় বয়োঃপ্রাপ্ত একমাত্র কন্যা আয়শা আক্তারকে বিয়ে দেন হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ থানার রামশ্রী গ্রামের রাজমিস্ত্রী বাবুল মিয়ার সাথে। কিন্তু, মেয়ের গর্ভজাত ২ নাতিন জন্মের পর জামাতা বাবুল মিয়াও ক্যান্সারাক্রান্ত হয়ে মারা যান। ফলে, ২ নাতিনসহ কন্যা আয়শা ফিরে আসে মা মিনারার সংসারে। বর্তমানে বিভিন্নজনের সহযোগিতায় ২ নাতিন স্থানীয় শাহ হেলাল উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। একসময় সংসারের একমাত্র রোজগারী ছিলো বড় পুত্র দুলাল মিয়া। সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে যা আয় হতো তা দিয়েই কোনরকমে চলে যাচ্ছিলো মিনারার সংসার। কিন্তু, দূর্ভাগ্যজনকভাবে ২০১৯ সালে সরকার বাজার এলাকায় হবিগঞ্জ-সিলেট বিরতিহীন বাসের সাথে সংঘর্ষে পুত্র দুলাল মারা যায়। ২য় পুত্র জালাল মিয়া রোজকামলা খাটে। আর, ছোট পুত্র বেলাল মিয়া টমটম চালক। বৃদ্ধ মা, ২ নাতিনসহ বিধবা কন্যা ও ২ পুত্র মিলিয়ে মিনারার ৭ জনের পরিবার।
মিনারা দীর্ঘ ১০/১২ বছর যাবৎ পশ্চিম মোস্তফাপুর, খিদুর ও পূর্ব হিলালপুর এলাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করে আসছেন। ৪ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় তার বর্তমান বসবাস খিদুর গ্রামে। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা মিনারার জীবনটা শুরু থেকেই শুধুই কষ্টের। স্বামীর মৃত্যুর পর ৩ সন্তানকে লালনপালন করলেন। এখন আবার বৃদ্ধ মা এবং বিধবা মেয়ে ও তার ২ সন্তানের দায়িত্ব পালণ করতে গিয়ে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবেই চলছে মিনারার সংগ্রামী জীবন। জীবন-জীবিকার জন্য তিনি বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে শাক-সবজি ও ফলমূল বিক্রি করছেন। এ ব্যবসার পুজি দিয়ে সহায়তা করেছেন আশপাশের বেশ কয়েকজন মানবিক মানুষ। তাদের কাছে তিনি ঋণী।
মৌলভীবাজার শহরের হিলালপুরস্থ বাহারমর্দান রাস্তার মুখের ফুটপাতে বসে কখনো শাকসবজি এবং কখনো ফলমূল বিক্রি করেন তিনি। এ ব্যবসার আয়ে নির্বাহ হয় তার ৭ সদস্যের জীবিকা। প্রতিদিন ২/৩ শ টাকা আয় হয়। তা দিয়েই কোনরকম টেনেটুনে চলেন তিনি। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় এ সামান্য আয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে গেছে। মাংস খাওয়া হয়না অনেক দিন ধরে। ডিম, ডাল ও সবজি বেশি খাওয়া পড়ে। স্বামী ছাড়া একজন নারীর পক্ষে সংসার চালানো খুবই কষ্টের। এভাবেই সংগ্রাম করে কোনরকমে টিকে থাকতে হচ্ছে। এ সংগ্রাম হয়তো শেষ হবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
মিনারা বেগম বলেন- সরকার তো লাখ লাখ মানুষকে জমিসহ ঘর দিয়েছেন। আমাকে এরকম জমিসহ একটা ঘর দিলে কিছুটা হলেও ভালো থাকতে পারতাম। আমার বাসার কাছে হিলালপুর আশ্রয়ন প্রকল্পে অনেক ঘর খালি আছে। যাদেরকে দেয়া হয়েছে তারা এখানে থাকছে না, থাকবেও না। অথচ, আমার মতো অসহায় নারী মাথাগোঁজার মতো ঠাই পাচ্ছিনা। আমি এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। খিদুর গ্রামের রুয়েল আহমদ বলেন- মিনারাকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি। মিনারা হার না মানা এক জীবনসংগ্রামী নারী। নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে টিকে থাকার প্রচন্ড শক্তি, সাহস ও মনেবলে বলীয়ান সে। সরকারী যেকোন অনুদান পাবার যথাযথ যোগ্য মিনারাকে আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমিসহ একটি ঘর দেয়া হলে, সে কিছুটা হলেও ভালোভাবে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকতে পারতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *