রোদ-বৃষ্টির মাঝে কাজ আর ভাঙ্গা ঘরে বসবাস করেই জীবন কাটায় চা শ্রমিকরা

রোদ-বৃষ্টির মাঝে কাজ আর ভাঙ্গা ঘরে বসবাস করেই জীবন কাটায় চা শ্রমিকরা

ইশরাত জাহান চৌধুরী :: খোলা আকাশের নীচে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কাজ আর ভাঙ্গা ঘরে বসবাস করেই জীবন কাটায় চা শ্রমিকরা। তাদের জন্মই যেন চা-বাগানের শ্রমিক হবার জন্য। তাদের মা-বাবা চা বাগানের শ্রমিক ছিলেন। তারাও চা বাগানের শ্রমিক। তাদের সন্তানরাও চা-বাগানের শ্রমিকই হবে। চা শ্রমিকরা তাদের সন্তানদেরকে লেখাপড়া শিখিয়ে যে অন্য পেশায় পাঠাবে, সে ক্ষমতা তো তাদের নেই। আগে মজুরি কম ছিল। এখন মজুরি কিছু বাড়লেও, এ মজুরি দিয়ে তাদের পোষায় না। এদেশে ১৭০ টাকা দিয়ে কোন কাজ আছে, যে ৮ ঘন্টা কাজ করে দিবে। কিন্তু, চা শ্রমিকরা তো বান্ধা পড়ে গেছে। না তারা শিক্ষার দিকে এগোতে পারে, না ভূমি কিনে ঘর বাড়ি বানাতে পারে। সূর্যের দিকে যেভাবে তাকানো যায়না। তাদের জীবনও সেভাবে। তারা জীবনের দিকে তাকাতে পারেনা।
দেশের সিংহভাগ চা বাগান অবস্থান মৌলভীবাজার জেলায়। বিভিন্ন চা বাগান ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ শ্রমিকের বসবাস মাটির তৈরি ঘরে। কোনো কোনো ঘরের উপরে শুকনো খড়ের ছাউনি, আর কোনো কোনো ঘরের উপরে টিনের ছাউনী। অনেক ঘরেই খড় আর টিনের ফুটো দিয়ে আকাশ দেখা যায়। কোনো কোন ঘরে একটাই কক্ষ, কোনো কোনো ঘরে দুটি কক্ষ। খুব বেশি হলে একটি আলাদা রান্নাঘর। বসতকক্ষের আয়তনও বেশি নয়। লম্বায় ১৫ ফুট আর চওড়ায় ৬ ফুট। এসব কক্ষের একপাশে মাটির ওপর পাটি বিছিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন ৩ থেকে ৭ জন। অনেক কক্ষে আবার মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুরও বসবাস রয়েছে। তাও আবার, চা বাগানের নিয়ম অনুযায়ী একটি পরিবার থেকে যদি নূন্যতম ১ জন শ্রমিক কাজ না করেন, তাহলে সেই পরিবার হয়ে যাবেন গৃহহীন। ওই পরিবার বাগানের বসতঘরে বসবাস করতে পারবেন না। কেউ কেউ অবশ্য নিজেদেন শ্রম ও অর্থে নিজ নিজ বসতঘরকে একটু স্বচ্ছন্দে বসবাসের উপযোগী করে বসবাস করছেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের বালিশিরা ভ্যালি ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক কর্ণ তাঁতি বলেন, স্থায়ী চা শ্রমিকরা সব কাজেই পান ১৭০ টাকা। অস্থায়ী চা শ্রমিকরা শুধু পাতা তোলার জন্য ১৭০ টাকা আর অন্য কাজের জন্য ১২০ টাকা বা এর কম পান। আমরা বারবার দাবী জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। যুগ যুগ ধরে কাজ করেও আমরা চা শ্রমিকরা বসতঘরের নিশ্চিয়তা পাইনা।
বাংলাদেশ চা শিল্প ২০১৯ এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ১৬৬টি চা বাগান রয়েছে। এসব চা বাগানে ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন স্থায়ী শ্রমিক এবং ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছেন। দেশের মোট চা জনসংখ্যা অর্থাৎ যারা স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকদের আয়ের উপর নির্ভরশীল, তাদের সংখ্যা ৪ লাখ ৭২ লাখ ১২৫ জন।
সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) পরিচালক চা শ্রমিক গবেষক ফিলিপ গাইন বলেন- বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা, যাদের বেশিরভাগই অবাঙালি এবং ৫ প্রজন্ম ধরে চা বাগানের সঙ্গে আবদ্ধ, তাদের জীবন মর্যাদাপূর্ণ নেই। বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসাসহ জীবনের মৌলিক চাহিদার গ্যারান্টি দেয়। চা শ্রমিকদের চাহিদা পূরণের দায়িত্ব চা বাগানের মালিক এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ উভয়েরই।
চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সিলেট চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন- চা বাগানের প্রয়োজনে শ্রমিকদেরকে চা বাগানে রাখা হয়। চা বাগানের মালিকরাই তাদের বসতঘর তৈরী করে দেন। বসতঘরের জন্য তাদের কোন ব্যয় হয়না। আর, ভূমির মালিকানা তো চা বাগানের বা চা বাগান মালিকদের নয়, সরকারের। চা বাগান মালিকরা তো সরকার থেকে ভূমি লিজ নিয়েই চা চাষাবাদ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *