শ. ই. সরকার জবলু :: বুকভরা অভিমান নিয়েই চিরবিদায় হলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অনুঘটক এম এ রহিম। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবে। আবেদন জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রের প্রতি। কিন্তু, প্রতিহিংসা ও নোংড়া রাজনীতির কুটচালের কারণে তার সেই আবেদনে সাড়া দেয়নি রাষ্ট্র। শেষমেষ দল থেকে অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসিত অবস্থায় বিশাল এক অপূর্ণতার বুকভরা ব্যথা ও একরাশ অভিমান নিয়ে প্রায় নিরবেই অনন্ত যাত্রার পথিক হলেন ত্যাগী এ মানুষটি।
শুধু এম এ রহিমই নন, প্রায় একইভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং নোংড়া রাজনীতির কুটচালে দলীয় রেষারেষি ও কোন্দলে কোনঠাসা হয়ে দল ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন শ্রীমঙ্গলে আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালণকারী মরহুম ডাঃ আব্দুল আলী। প্রায় একইভাবে একসময় ভারাক্রান্ত মানসে দল ত্যাগ করেছিলেন অতুলনীয় বাগ্মিতা দিয়ে আওয়ামীলীগ মঞ্চকে মুখর রাখায় ও রাজনৈতিক তপস্যায় অটল সেনানী স. আ. মুজিব। প্রয়াত এমপি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং নোংড়া রাজনীতির কুটচালের শিকার হয়ে প্রায় কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু, তিনি হাল না ছাড়ায় এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রীত্ব লাভ করায় প্রায় কোনঠাসা অবস্থা থেকে উৎরে যেতে পেরেছিলেন। তা নাহলে তারও রাজনৈতিক ভবিষ্যত অনিশ্চিত ছিলো।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে নয়-ছয় হয়েছে এবং হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে তৎকালীন এমএনএ এবং এমপি এদের অনেকের নাম অন্তর্ভূক্ত হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্তেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভূক্ত না থাকার কারণে ‘গার্ড অব অনার’ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। তাদের পথ ধরে এম এ রহিমও হলেন এ বঞ্চনার শিকার।
অথচ শ্রীমঙ্গল তথা মৌলভীবাজারের মুক্তিযুদ্ধের অনুঘটক হিসাবে এম এ রহিম ছিলেন অন্যতম। এক সাক্ষাৎকারে কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী জানিয়েছিলেন ২৭ মার্চ রাতে হবিগঞ্জ থেকে নবগঠিত মুক্তিবাহিনী সম্মুখযাত্রা শুরু করে বাহুবল থানার পাহাড়ি এলাকায় প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করেছিলো। সেই রাতেই শ্রীমঙ্গল থেকে ইসমাইল হোসেন এবং এম এ রহিম অকুস্থলে ছুটে এসেছিলেন। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পরদিনই মুক্তিবাহিনীকে শ্রীমঙ্গলে নিয়ে আসা হয়। দুটি স্থানে ট্রেনিং সেন্টার চালু করাসহ অগ্রাভিযানের ছক তৈরী করা হয়েছিলো শ্রীমঙ্গল থেকে। তৎকালে এম এ রহিমের ভূমিকা ছিলো সর্বজনবিদিত। জানা মতে এবং সদ্যপ্রয়াত এম এ রহিমের ভাষ্যানুসারে- ইয়ুৎ ক্যাম্পের মাধ্যমে এম এ রহিম কোনো ট্রেনিং সেন্টারে যুদ্ধের ট্রেনিং নেননি। সে কারনে সরাসরি সম্মুখ সমরে অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু, তিনি যে যুদ্ধে ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন, শ্রীমঙ্গল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দুই দুই বারের কমান্ডার ছিলেন, শ্রীমঙ্গল থানা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এসব তো অস্বীকার করা যাবেনা। শুধু তাই নয়, ’৭৫ সালের পট পরিবর্তন ও দলীয় ভাঙ্গনে শ্রীমঙ্গল আওয়ামীলীগের যখন হ-য-ব-র-ল অবস্থা, তখন এম এ রহিমের ভূমিকা ছিলো অনন্য। জেল-জুলুমকে অগ্রাহ্য করে দলীয় অবস্থানকে সংহতকরণে তিনি ছিলেন নিবেদিত।
এছাড়াও, শ্রীমঙ্গল পৌরসভার সাবেক দুই দুইবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান, শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন কমিশনার, শ্রীমঙ্গল সূর্যের হাসি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা, উদয়ন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, শ্রীমঙ্গল উপজেলা ও মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের অন্যতম নেতা, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন শ্রীমঙ্গল শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, উদীচী শ্রীমঙ্গল শাখার সাবেক সভাপতি এবং সাপ্তাহিক শ্রীভূমি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক এম এ রহিম ছিলেন একজন ত্যাগী রাজনীতিবিদ। তার নিরহংকারীতা, পরোপকারীতা, নম্রতা, ভদ্রতা ও সততা ছিলো নিঃসন্দেহে উল্লেখ করার মতো। অথচ, তিনিই হলেন দলের কাছ থেকে ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বঞ্চিত। সর্বোপরী, স্থানীয় এমপি আব্দুস শহীদ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা সত্তেও, মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হলেন এম এ রহিম। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও নোংরা রাজনীতির কুটচালের কারণে এম এ রহিমের মতো মানুষটিকে মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হলোনা।
তার প্রথম জানাযায় মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও মৌলভীবাজার-৩ আসনের সাংসদ নেছার আহমদ, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ও মৌলভীবাজার-৪ আসনের সাংসদ মোঃ আব্দুস শহীদ, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক ও মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মোঃ ফজলুর রহমান, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শ্রীমঙ্গল দ্বারিকা পাল মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ মনসুরুল হক মৌলভীবাজার জেলা জাতীয় পার্টির আহবায়ক ও শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী কামাল হোসেন, কমলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুর রহমান, কমলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এড. আজাদুর রহমান প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছেন। গভীর শোক ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সাংবাদিক, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও, তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন মৌলভীবাজার-১ আসনের সাংসদ এবং বন ও পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।