সুরমার ঢেউ সংবাদ :: সুনামগঞ্জ জেলা ভারতের আসাম রাজ্যের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত । বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে এ জেলায়। নিম্নে সেগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
টাঙ্গুয়ার হাওর ঃ দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো টাঙ্গুয়ার হাওর। তাহিরপুর, মধ্যনগর, জামালগঞ্জ এ ৩টি উপজেলা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। অথৈ পানি, জলাবন, নীল আকাশ, পাহাড় ও চোখ জুড়ানো সবুজ এ হাওরকে সাজিয়েছে অপরুপ সাজে। টাঙ্গুয়ার হাওরের মোট আয়তন ৬ হাজার ৯শ ১২ একর। তবে, বর্ষাকালে এ হাওরের আয়তন বেড়ে প্রায় ২০,০০০ একর পর্যন্ত হয়ে থাকে। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ এবং ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃপের সমন্বয়ে জীববৈচিত্র গড়ে উঠেছে। টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়গুলো দেখা যায়। হাওরে একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। এর আশেপাশের পানি খুবই স্বচ্ছ হওয়ায় উপর থেকে হাওরের তলা দেখা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওরে দ্বীপের মত ভাসমান ছোট বড় প্রায় ৪৬টি গ্রাম বা দ্বীপ গ্রাম আছে। সুনামগঞ্জ জেলার পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে হাউস বোট। টাঙ্গুয়ার হাওরে এসকল হাউসবোটে রাত্রি যাপন করতে পারেন পর্যটকরা। বিভিন্ন প্যাকেজে হাউসবোট ভাড়া দিয়ে থাকে। হাউসবোটে রয়েছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা। আলাদা আলাদা কক্ষ, ওয়াইফাই, খাওয়া-দাওয়া, অত্যাধুনিক ওয়াশরুম, সার্বক্ষণিক জেনারেটর সুবিধা রয়েছে এগুলোতে।
শহীদ সিরাজ লেক বা নীলাদ্রি লেক ঃ টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ে রয়েছে আরেকটি দর্শনীয় স্থান শহীদ সিরাজ লেক বা নীলাদ্রি লেক। নীলাদ্রি লেক খ্যাত পর্যটন স্থানটি চুনাপাথরের পরিত্যক্ত খনির লাইম স্টোন লেক। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের টেকেরঘাট নামক গ্রামে নীলাদ্রি লেকের অবস্থান। এ লেকের প্রকৃত নাম শহীদ সিরাজ লেক। কিন্তু, পর্যটকদের নিকট এ লেক নীলাদ্রি লেক নামেই অধিক পরিচিত। অবশ্য স্থানীয় লোকজন একে টেকেরঘাট পাথর কোয়ারি নামে চেনে।
বারিক্কা টিলা ঃ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদী তীরবর্তী পর্যটন আকর্ষণ বারিক্কা টিলা। উপজেলা ভূমি অফিসের রেকর্ড মতে এটিকে বড়গুপ টিলা বলা হলেও, স্থানীয়ভাবে ও পর্যটকদের কাছে বারিক্কা টিলা নামেই বেশি পরিচিত। বারিক্কা টিলা সংলগ্ন দৃষ্টিনন্দন আঁকাবাঁকা রাস্তা ছাড়াও রয়েছে গারো সম্প্রদায়ের একটি বিশাল ফুটবল মাঠ, একটি স্কুল ও একটি অত্যাধুনিক গির্জা। পূর্ণিমা রাতে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, যাদুকাটা নদী ও বারিক্কা টিলা চাঁদের আলোয় একাকার হয়ে যায়। সুউচ্চ হওয়ায় যাদুকাটা নদী থেকেও বারিক্কা টিলাকে আলাদা করে দেখা যায়।
জাদুকাটা নদী ঃ বারিক্কা টিলার নিকটে অবস্থিত জাদুকাটা নদী। ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে তাহিরপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এ অপরূপ নদী।
পাহাড় বিলাস ও হাওর বিলাস ঃ বিশম্বরপুর উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ চেংবিল। চেংবিল নামক স্থানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্থান। চেংবিল নামক স্থানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্র ‘পাহাড় বিলাস’। আর ‘হাওর বিলাস’ নামে আরেকটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে খড়চার হাওরের পাড়ে। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা কমপ্লেক্সের পাশেই অবস্থান হাওর বিলাসের। হাওরের পরিবেশ উপভোগের জন্য পানির ওপরে ভাসমান দুটি গোল ঘর নির্মাণ করে এর নাম দেয়া হয়েছে ‘হাওর বিলাস।
শিমুল বাগান ঃ সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে শিমুল বাগানের অবস্থান। ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, মাঝে যাদুকাটা নদী আর এপারে শিমুল বাগান। যাদুকাটা নদী পেরিয়ে যেতে হয় এ বাগানে। বিস্তির্ণ বালুচর পায়ে হেঁটে গিয়ে শিমুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয়। শিমুল বাগানে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই ফুল ফুটতে শুরু করে। লাল ফুলের কল্যাণে পুরো এলাকায় ফুটে ওঠে রক্তিম আভা। মানিগাঁও গ্রামের ১০০ একর অঅয়তনের এ শিমুল বাগানের নয়ণাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়।
টেরাকোটা ও ম্যাপ ফোয়ারা ঃ বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশেই অবস্থিত টেরাকোটা ও ম্যাপ ফোয়ারা। এটি একটি দৃষ্টিনন্দন স্থান।
বোয়াল চত্বর ঃ বিশম্বরপুর উপজেলার আরেকটি দর্শনীয় স্থান হল বেয়াল চত্বর। এটি স্থানীয় কারেন্টের বাজারে অবস্থিত।
কৃষাণ চত্বর ঃ বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর সড়কের পাশে চালবন পয়েন্টে কৃষাণ চত্বর অবস্থিত। এটিও একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা।
ডলুরা স্মৃতিসৌধ ঃ সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর। এখানেই অবস্থিত ডলুরা শহীদ সমাধি। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশের স্থানটি জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটারের পথ। এলাকাটি যেন সবুজে মোড়া। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট ঘরবাড়ি দোকানপাট। একপাশে নদীর কলতান। অন্যদিকে সবুজ পাহাড়ের হাতছানি। শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশ। এখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ‘মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্য’। সাথে রয়েছে সারি সারি শহীদ সমাধি। প্রতিটি সমাধিতে লাগানো আছে দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করা শহীদদের নামফলক। ৪৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ৬ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাঁদের এখানে দাহ করা হয়। এ ৪৮ শহীদের মধ্যে অনেকেরই পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা ছিলনা। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়।
বাঁশতলা হক নগর স্মৃতিসৌধ ঃ সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্তঘেরা মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের সম্মানে দাঁড়িয়ে আছে বাঁশতলা-হকনগর শহীদ স্মৃতিসৌধ। এটি দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থিত। সুনামগঞ্জের পর্যটন এলাকা হিসেবে যে ক’টি স্থান ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে, এর মধ্যে এটিও একটি। পাহাড়ি মনমাতানো এ দৃশ্য পর্যটকদের হাতছানি দিচ্ছে প্রতিনিয়তই।
জুমগাও ঃ ভারতীয় সীমানার কোলঘেঁষা বাংলাদেশের জুমগাঁও গারো পাহাড়ের অবস্থান। অন্তত ২০০ বছরের পুরনো আদিবাসীদের ছোট্ট একটি পাহাড়ি গ্রাম। এটি বাশতলা স্মৃতিসৌধের কাছাকাছি অবস্থিত। এখানকার প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার মতো। জুমগাঁও গ্রামে আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের প্রায় ২৬টি পরিবার বসবাস করেন। এ এলাকার চারিদিকে সবুজের হাতছানি। শেষ বিকেলে পাখির কলকাকলী ও বিকেলের মিষ্টি রোদে মৃদু বাতাস প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। বিস্তৃর্ণ এলাকায় ছোট ছোট টিলা আর পাহাড়ে সাজানো দৃশ্য নজরকাড়া। এখানকারর পাহাড়ি ঝরনা চোখে পড়ার মতো।
এছাড়া সুনামগঞ্জ জেলা শহরে রয়েছে দুটি দৃষ্টিনন্দন দর্শনীয় স্থান। একটি হলো রিভারভিউ অন্যটি হলো ১০০ মুজিব পার্ক। সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের পাশে সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত রিভার ভিউ। আর, সুরমা নদীর তীরে সদর উপজেলা পরিষদের পেছনে অবস্থিত ১০০ মুজিব পার্ক।