শ. ই. সরকার জবলু ঃ আর মাত্র একদিন, তার পরদিনই অমর একুশে ফেব্রুয়ারী। বাঙালির মননে অনন্য মহিমায় ভাস্বর চিরস্মরণীয় একুশে ফেব্রুয়ারী। বিশ্বজুড়ে মানুষের নিজ নিজ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকারের নাম অমর একুশে ফেব্রুয়ারী। আগামী মঙ্গলবার সেই অমর একুশে ফেব্রুয়ারী, মহান ভাষাশহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশে ফেব্রুয়ারী মানে বিশ্বে মাতৃভাষার জন্য নির্ভয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দেয়ার প্রথম ইতিহাস সৃষ্টির দিন। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় শোকের দিন। দিনটিতে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে ধ্বনিত হবে হৃদয় নিংড়ানো একটাই সুর, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি’ ? কালজয়ী অজেয় শব্দাবলীর এ গানটি রচনা করেছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহিদ আলতাফ মাহমুদ।
২০ ফেব্রুয়ারী সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে শুরু হবে বাংলা ভাষার দিন ২১শে ফেব্রুয়ারী। ফুলে ফুলে ঢেকে যাবে সারাদেশের শহিদ মিনারগুলো। ওই ফুল গভীর শ্রদ্ধার, অকৃত্রিম ভালোবাসার। ওই ফুলগুলোর আর কোনও নাম নেই। রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত সফিউরসহ নাম না জানা আরো অনেক শহীদের নামই ফুলগুলোর নাম। বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের দিনটি পালণে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হবে নানা কর্মসূচি। মহান শহীদদের স্মরণে দিনটিতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে এবং শোকের নিদর্শন কালো পতাকা ওড়ানো হবে। দিবসটি উপলক্ষ্যে পৃথক পৃথক বাণী দেবেন এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রথম ফুল দেবেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর থেকে সকলের জন্য রাতভর খোলা থাকবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর। শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব চলবে সকাল সকাল পর্যন্ত। জাতীয় দিবস হিসেবে দিনটিতে থাকবে সরকারি ছুটি। সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ছাড়াও টেলিভিশন ও বেতারে প্রচার করা হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। পৃথক পৃথক বিভিন্ন কর্মসূচি পালণ করবে সকল বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা, সকল রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারীর প্রথমদিন থেকেই রাজধানী ঢাকায় শুরু হয়েছে অমর একুশের বইমেলা। সারাদেশ জুড়ে একদিকে যেমন বিভিন্ন এলাকায় বইমেলার আয়োজন তেমনি সারাদেশ জুড়ে শহীদ মিনারগুলো প্রস্তুত হয়ে রয়েছে শ্রদ্ধা জানানোর অপেক্ষায়। একুশের প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি চলছে ঘরে ঘরে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি ?’ গানের হৃদয় নিংড়ানো সুরে সুরে নগ্ন পায়ে শোকাবহ প্রভাতফেরির বহর এসে মিলবে স্থানীয় শহীদ মিনারে। শুধু বাংলাদেশ জুড়েই নয়, পৃথিবীর যেখানে যেখানে বাঙালি আছেন সেখানেই পালিত হবে অমর একুশে। সিয়েরালিয়ন বা নিউইয়র্ক, লন্ডন বা মধ্যপ্রাচ্য সর্বত্রই অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো হবে।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৫২ সালের এ দিনটিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত সফিউরসহ নাম না জানা আরো অনেক বাংলার দামাল ছেলেরা। তাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি। এরপর থেকে ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে দিনটি। পরবর্তীতে ২১শে ফেব্রুয়ারী পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। ৫২’র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই বাঙালি জাতির চরম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। এর পথ ধরেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম নেয় লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
১৯৫২ সালের আন্দোলনটা ছিল বাংলাভাষার, বাঙালির, বাংলাদেশের। না, বাংলাদেশ তখনও বাংলাদেশ হয়ে ওঠেনি, ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাগ করা পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ। পুরো পাকিস্তানের ৫৪ শতাংশ নাগরিকই ছিলেন বাঙালি- যাঁদের মাতৃভাষা বাংলা। সেই বাংলাকে বাঙালির মুখ থেকে কেড়ে নেয়ার আয়োজন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের। পৃথিবীর ইতিহাসে আন্দোলন যুদ্ধ অনেক হয়েছে। তবে, ভাষার জন্য আন্দোলন যুদ্ধের ইতিহাসটা একমাত্র বাঙালিরই। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্যে রাজপথে বুকোর তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মায়ের ভাষা তথা বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সারাবিশ্বে একটাই। আর, সে ইতিহাসটা একমাত্র বাঙালিদের।
সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান শুরু থেকেই বাঙালি জনগোষ্ঠীকে তার শিকড় থেকে উপড়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল। একটি জাতিগোষ্ঠীর কাছে তার ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক কোন মিলই ছিলনা।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব বাংলার ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলতেন এবং ভাষা হিসেবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি মানুষ বাংলা ভাষাতেই কথা বলতেন। কিন্তু, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা এবং স্কুল ও মিডিয়ায় উর্দু ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব দেয়া হলে, শুরু হয় প্রতিবাদ। কিন্তু, এর মধ্যেই পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন অনুমোদিত বিষয় তালিকা, মুদ্রার নোট থেকে বাংলাকে মুছে ফেলে তৎকালীন পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। প্রতিবাদ, প্রতিরোধও চলতে থাকে সমানে। যে প্রতিরোধের চূড়ান্ত রূপটিই ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারী। রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত সফিউরসহ নাম না জানা আরো অনেকের জীবনের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাঙালির মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার।
১৯৯৮ সালে কানাডায় বসবাসকারী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন সেই সময়ের জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের কাছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরের বছর ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী থেকে জাতিসংঘের সদস্য বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একযোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এরপর বাংলাদেশ ২০১০ সালে জাতিসংঘের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালণ করার প্রস্তাব উত্থাপন করলে, সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাবটি পাস হয়। এখন অমর ২১শে আর শুধু বাংলাদেশ বা বাঙালির নয়, সারাবিশ্বের প্রতিটি দেশে পালিত হওয়া একটি অদ্বিতীয় মর্যাদাপূর্ণ দিন- যা বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ গর্বের- যে গর্ব বেঁচে থাকবে চিরদিন।