ইশরাত জাহান চৌধুরী :: মৌলভীবাজারে বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী অধিকার সুরক্ষা নাগরিক কমিটির সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরে। ঝিমাই খাসি পুঞ্জির শতবর্ষী প্রাকৃতিক গাছ কাটা বন্ধ, ঐতিহ্যবাহী পানজুম, পরিবেশ-প্রাণ-প্রকৃতি, আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা, প্রথাগত ভূমির মালিকানা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অস্তিত্ব রক্ষার্থে মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সংবাদ সম্মেলন তারা ৯ দফা দাবি জানান। তাদের এ দাবীর প্রতি সমর্থন জানায় কুবরাজ আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি জানানো ৯ দফা হলো- (১) ঝিমাই খাসি পুঞ্জির পান জুমের প্রাকৃতিক গাছ বিধি বহির্ভূত ভাবে কাটার পাঁয়তারা বন্ধ ও ঝিমাই পুঞ্জির যাতায়াতের রাস্তায় চা বাগান কর্তৃপক্ষের সকল বাঁধা অপসারন করতে হবে (২) ডুলুকছড়া, বেলকুমা, নুনছড়া সহ বিভিন্ন পুঞ্জির আদিবাসীদের বিরুদ্ধে হয়রানি মূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে (৩) সামাজিক বনায়নের আড়ালে প্রভাবশালী ভূমিখেকোদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে (৪) আদিবাসীদের ভোগদখলীয় প্রাকৃতিক বনভূমিতে কোন প্রকার সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ করা যাবেনা (৫) খাসিয়া পানচাষ পদ্ধতিকে বিশেষ কৃষি ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে উৎপাদন ও বিপননের সকল পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা দিতে হবে (৬) বিনা সুদে কৃষি ঋন ও পানের ন্যায্য বাজারমূল্য নিশ্চিত করতে হবে (৭) আদিবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশুদ্ধ পানি, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সংযোগ প্রভৃতি নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে (৮) আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমির মালিকানা ও শান্তিপূর্ন ভোগদখল নিশ্চিত করতে হবে এবং বৃহত্তর সিলেটের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের লক্ষে বিশেষ ভুমি কমিশন গঠন করতে হবে (৯) পান চাষের একমাত্র অবলম্বন প্রাকৃতিক গাছ কেটে আদিবাসীদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।
লিখিত বক্তব্যে কুবরাজ আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলি তালাং বলেন- মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ঝিমাই পুঞ্জির সাথে ঝিমাই চা বাগান (কেদারপুর টি কোম্পানী লিঃ) এর চলমান ভূমি বিরোধ, ঝিমাই চা বাগান কর্তৃক ঝিমাই পুঞ্জির পানজুমের আওতাধীন প্রায় দুই সহস্রাধিক প্রাকৃতিক গাছ কাটার প্রচেষ্টা চলছে। পুঞ্জিতে ৭২টি খাসিয়া পরিবারের বসবাস- যাদের সবারই পেশা পান চাষ। আদিবাসীদের বসতভিটা, বিদ্যালয়, গীর্জা, কবরস্থান সর্বোপরি তাদের জীবন জীবিকা বিপন্ন হবার আশংকা তৈরি হওয়ায় আমরা অত্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করছি। শতাধিক বছর ধরে এ পুঞ্জিতে খাসি আদিবাসীরা বসবাস করলেও ২০০৮ সালে প্রথম ঝিমাই চা বাগান কর্তৃপক্ষ ঝিমাই পুঞ্জির লক্ষনীয় ভূমির একাংশ নিজেদের লীজভুক্ত দাবি করেন এবং পানজুমের আওতাভুক্ত প্রাকৃতিক দুই সহস্রাধিক গাছ কাটার জন্য নানাবিধ পাঁয়তারা শুরু করেন। তিনি বলেন- কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক পুঞ্জিতে প্রবেশ করে গাছ মার্কিং শুরু করলে পুঞ্জিবাসীর পক্ষে মন্ত্রী রানা সুরং হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন যা বর্তমানে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রিভিউ হিসেবে চলমান আছে। অতি মুনাফালোভী চা বাগান কর্তৃপক্ষ ঝিমাই পুঞ্জির পান জুমের আওতাধীন দুই সহস্রাধিক প্রাকৃতিক গাছ নিজেরা রোপন না করেও অসাধুভাবে কাটার পাঁয়তারা করছেন। আমরা জোরালো ভাবে দাবি জানাচ্ছি ঝিমাই চা বাগান কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র তাদের চা সেকশনের ছায়াবৃক্ষ বিধি মোতাবেক কর্তন করতে পারেন। কিন্তু কোন অবস্থাতেই খাসিয়াদের জীবন জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ঝিমাই পুঞ্জির পান জুমের প্রাকৃতিক গাছ কাটা যাবেনা। বৃহত্তর সিলেট ত্রিপুরা উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি জনক দেববর্মা বলেন- মৌলভীবাজার জেলার পাহাড়ি বনাঞ্চলে প্রায় ৮০টি খাসি পুঞ্জি রয়েছে- যেখানে প্রধানত খাসি ও গারো আদিবাসীরা স্মরনাতীত কাল থেকে প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে আসছে। প্রায় প্রতিটি পুঞ্জিতেই সহস্রাধিক বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী পান চাষ, সংগ্রহ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত এবং রোজগারের একমাত্র অবলম্বন। আদিবাসীদের ভোগদখলীয় এ বনভূমি কাগজে পত্রে জেলা প্রশাসক এবং বনবিভাগের নামে হবার কারণে দীর্ঘদিন যাবত বনবিভাগ ও চা বাগান কর্তৃপক্ষের সাথে বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা, বনবিভাগ কর্তৃক খাসিদের উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে মিথ্যা বনমামলা দায়ের করে হয়রানি, খাসিদের ভোগদখলীয় প্রাকৃতিক বনে সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ করে স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিখেকোদের সম্পৃক্ত করে আদিবাসীদের সাথে সংঘাতময় পরিস্থিতি এখানকার বর্তমান বাস্তব চিত্র।
সংবাদ সম্মেলনে বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী অধিকার সুরক্ষা নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাড. ডাডলি ডেরিক প্রেন্টিস, অ্যাড. আবুল হাসান, ঝিমাই পুঞ্জির মন্ত্রী রানা সুরং, বাপা’র মৌলভীবাজার জেলা আহ্বায়ক আ স ম সালেহ সোহেল, সিপিবির জেলা সাধারন সম্পাদক নিলিমেষ ঘোষ বুলু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন।