সিলেটের উদ্যোক্তারা পাম চাষ করে হতাশ

সিলেটের উদ্যোক্তারা পাম চাষ করে হতাশ

সুরমার ঢেউ সংবাদ :: সিলেটের উদ্যোক্তারা পাম চাষ করে হতাশ। সিলেট বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল। বিপুল পরিমাণ জমি এখনো অনাবাদি। আর সেই জমিতে বিদেশী পাম চাষ করে তেল উৎপাদনের সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। অনেক উদ্যোক্তাই তখন এগিয়ে এসেছিলেন। কেউ কেউ শুরুও করেছিলেন পাম চাষ। কিন্তু, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াকরণের অভাবে সেটি আর শিল্পে রূপ পায়নি। ফলে পাম বাগানে সম্ভাবনা তো দূরে থাক, উল্টো যেন রূপ নিয়েছে গলার কাঁটায়।
সিলেটের সবচেয়ে বড় পাম বাগানটি গড়ে উঠেছে শহরতলির খাদিমপাড়া এলাকার খাদিম চা বাগানের ভেতর। ৩০০ একর ভূমিতে লাগানো হয়েছে ৪ হাজার গাছ। দিনে দিনে গাছগুলো বেশ উঁচু ও হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। দৃষ্টিকাড়া বাগানে তাই প্রতিদিন ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। বড় গাছগুলো থেকে সফলভাবেই উৎপাদন হচ্ছে পাম। সেগুলো বিক্রি হচ্ছে স্বল্প দামে। তবে, সিলেটে পাম তেল প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা না থাকায় কোনো লাভই পাওয়া যাচ্ছে না।
খাদিম পাম বাগান কর্তৃপক্ষ পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনার খরচ তুলতে পারলেও জৈন্তাপুরের উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আলী মাক্কুরের গল্পটা খুবই করুণ। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি নিজের জমিতে লাগানো সাড়ে ৪ হাজার পাম গাছ কেটে ফেলেছেন। সেখানে নতুন করে লাগিয়েছেন মাল্টার চারা। এ বিষয়ে মোহাম্মদ আলী মাক্কু জানান, ২০০৮ সালে লাগানো সাড়ে ৪ হাজার পাম গাছের চারা ১০ বছর পরিচর্যা করে ১ টাকাও আয় হয়নি, বরং গাছগুলো পরিচর্যা করতে গিয়ে জলে ফেলতে হয়েছে লাখ লাখ টাকা। আর সেই খরচ জোগাতে গোয়ালের গরু ও স্ত্রীর স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করতে হয়েছে। একসময় হতাশ হয়েই পাম গাছগুলো কেটে ফেলেন এ উদ্যোক্তা।
মোহাম্মদ আলী মাক্কু বলেন, পাম চাষে লাভবান হবার স্বপ্ন দেখিয়েছিল কৃষি বিভাগ ও কিছু কোম্পানি। তাদের প্রলোভনে আমিসহ সিলেটের অনেকেই বিদেশী পাম চাষে পা বাড়াই। একটি কোম্পানির কাছ থেকে ২৫০ টাকা করে সেই গাছের চারা কিনি। ফলও ধরেছিল। কিন্তু, প্রক্রিয়াজাতের মেশিন না থাকায় তেল করা সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে পচে নষ্ট হয়েছে সে ফল।
পাম চাষ নিয়ে মোহাম্মদ আলী হতাশাজনক বক্তব্য দিলেও খাদিম পাম বাগানের উদ্যোক্তা আফজাল রশীদ চৌধুরী এখনো শোনাচ্ছেন সম্ভাবনার গল্প। মীনা আফজাল ইন্ডাস্ট্রিজের এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, সিলেট অঞ্চলে প্রচুর টিলাভূমি রয়েছে। এখানে অনেক বৃষ্টিপাতও হয়। সব মিলিয়ে পাম চাষের জন্য উপযোগী জায়গা। অন্যদিকে তার বাগানের বেশকিছু ভূমি অনাবাদি পড়েছিল। ফলে অনেকেই দখলের চেষ্টা করে। তাই কয়েক বছর আগে বাগানের সীমানা এলাকার প্রায় ৩০০ একর ভূমিতে তিনি পাম চাষ করেন। সেই গাছগুলোয় এখন ফল ধরছে। কিন্তু, প্রক্রিয়াকরণের অভাবে সম্ভাবনা থাকলেও তিনি কোনো কাজেই লাগাতে পারছেন না। আফজাল রশীদ চৌধুরী জানান, বর্তমানে কিছু ফল ৬০-৭০ টাকা কেজি ধরে বিক্রি করছেন একটি সাবান কোম্পানির কাছে। সব মিলিয়ে যে টাকা পাওয়া যায় বাগান পরিচর্যায় নিয়োজিত ৩ কর্মচারীর বেতন হয়। এর বাইরে কোনো সুফল পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব ও সরকারের অসহযোগিতার জন্যই সম্ভাবনাময় পাম চাষ শিল্পে রূপ নেয়নি। তেল উৎপাদনে যেতে হলে প্রক্রিয়াকরণ মেশিন দরকার, যার দাম প্রচুর। সবচেয়ে ছোট মেশিন স্থাপন করতে হলেও অন্তত পাঁচ হাজার একর জমিতে পাম চাষ করতে হবে। তবে সিলেটের চা বাগানগুলোতে যে পরিমাণ অনাবাদি ভূমি রয়েছে তাতে এটি সম্ভব। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। এ উদ্যোক্তা আরো দাবি করেন, তার ৩টি চা বাগানের অন্তত ১ হাজার একর অনাবাদি ভূমিতে পাম চাষের সুযোগ ছিল, কিন্তু টি-বোর্ড অনুমতি দেয়নি। খাদিম বাগানেও পাম চাষ সম্প্রসারণ করতে দেয়নি। ফলে অঙ্কুরেই মৃত্যু হচ্ছে এ সম্ভাবনার।
ব্যক্তি পর্যায়ে সিলেটে অনেকেই দুটি, চারটি, দশটি করে পাম গাছ কিনে লাগিয়েছিলেন, কিন্তু সবাই আজ হতাশ। সঠিক দিকনির্দেশনা না পেয়ে মাক্কুর মতো অধিকাংশ চাষীই গাছগুলো কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। এ বিষয়ে মোহাম্মদ আলী মাক্কু বলেন, কৃষি কর্মকর্তাদের কাছে গিয়েছি। তারা বলেছে, এটি প্রক্রিয়াজাত করার কোনো মেশিন এখনো আসেনি। অন্য যারা গাছ লাগিয়েছিল তাদের কাছেও গিয়েছি। সবারই বক্তব্য মেশিন না থাকায় বিপদে আছি। সিলেট চেম্বারের সাবেক সভাপতি এটিএম শোয়েব বলেন, সিলেটে পাম চাষের সম্ভাবনা ও প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন। ব্যবসায়ীরা আদৌ লাভবান হবেন নাকি ক্ষতির মুখে পড়বেন, বিনিয়োগের আগে তা যাচাই-বাছাই করতে হবে। তাছাড়া যতই স্বপ্ন দেখানো হোক না কেন, সিলেটে তেল প্রক্রিয়াজাতের জন্য কারখানা গড়ে না তুললে এ পাম চাষ কখনো শিল্পে রূপ নেবেনা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট অঞ্চলের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা জানান, সিলেটে পাম হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণা নেই। তবে, কেবল সিলেট নয়, পাম প্রক্রিয়াজাতের ভালো ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশের কোথাও নেই বলে জানান তিনি। (তথ্যসূত্র : বণিক বার্তা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *