সুরমার ঢেউ সংবাদ :: মৌলভীবাজারে ইজিপিপি’র ৩৮ প্রকল্পের ৮৮ লাখ টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে। জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অতিদরিদ্রদের কর্মস্থান কর্মসুচী (ইজিপিপি) প্রকল্পে ২০২১-২২ অর্থবছরের ২য় পর্যায়ের ৪০ দিনের কাজে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে ৮৮ লাখ টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে। ৩৮টি প্রকল্পের মধ্যে ৫/৭ টি প্রকল্পে নামমাত্র মাটি ফেলে বাকী প্রকল্পের কাজ কাগজে কলমে শতভাগ বাস্তবায়ন দেখিয়ে ৮৮ লাখ টাকা নানা কায়দায় লুটপাট করেছেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতিরা। বাস্তবে প্রকল্পের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়- ২০২১-২২ অর্থবছরে অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসুচীর আওতায় জেলার শ্রীমঙ্গল ও জুড়ি উপজেলায় দুর্যোগ ও ত্রান মন্ত্রনালয়ের আওতায় দূর্যোগ ব্যবস্থপনা অধিদপ্তর গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসাবে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অধিদপ্তরের উদ্যোগে ২য় পর্যায়ে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের আওতায় মির্জাপুর ইউনিয়নে ৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ৪টি প্রকল্প, ভূনবীর ইউনিয়নে ৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ৪টি প্রকল্প শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নে ১২ লাখ ২১ হাজার টাকা ব্যয়ে ৫টি প্রকল্প, সিন্দুরখান ইউনিয়নে ৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ৫টি প্রকল্প, কালাপুর ইউনিয়নে ১৩ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ৫টি প্রকল্প, আশিদ্রোন ইউনিয়নে ১১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ৫টি প্রকল্প, রাজঘাট ইউনিয়নে ৯ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ৪টি প্রকল্প, কালিঘাট ইউনিয়ে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে ৪টি প্রকল্প ও সাতগাঁও ইউনিয়নে ৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা ব্যয়ে ২টি প্রকল্পসহ মোট ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩৮টি প্রকল্প গ্রহন করা হয়।
কাগজে কলমে বাস্তবায়িত মাটির কাজের ৩৮টি প্রকল্পে বরাদ্ধের অনুপাতে ২৫/৩০ জন করে মোট ১০৯৭ জন শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়। সরকারের শর্তমতে প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতে এলাকার দিনমজুর, বেকার, কর্মহীন নারী পুরুষরা শ্রমিক হিসাবে তালিকাভুক্ত হবেন এবং তারা টানা ৪০ দিন কাজ করবেন এবং জনপ্রতি দৈনিক ৪শ টাকা করে পাবেন। এতে প্রতিজন শ্রমিক পাবেন মোট ১৬ হাজার টাকা। প্রকল্পের শ্রমিকদের টাকা রকেট বা বিকাশ একাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। কিন্তু, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ২য় পর্যায়ের ৪০ দিনের মধ্যে ২০ দিনের কাজ না করেই বরাদ্দের টাকা ব্যাপক লুটপাট করা হয়েছে। প্রকল্প সভাপতি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও উপসহকারী প্রকৌশলীর যোগসাজসে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে ৩৮টি প্রকল্পের টাকা তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। শুধু শ্রমিক নিয়োগে অনিয়মই নয়, বেশ কয়েকটি প্রকল্পের অস্তিতই খুঁজে পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টরা কাজ না করিয়েই ৩০টি প্রকল্পের পুরো অর্থই হাতিয়ে নিয়েছেন। একই অর্থ বছরে ২৭টি প্রকল্পের কাজের গুণগত মান কিছুটা পাওয়া গেলেও, ২য় পর্যায়ের প্রকল্প কার্যদিবসের ১৪ দিনই বৃষ্টি থাকায় কোন কাজই হয়নি। বরাদ্ধের ২য পর্য়ায়ে ৪০ দিনের মধ্যে প্রথম ২০ দিনের টাকা সরকারী কোষাগারে ফেরত গেলেও, শেষ ২০ দিনের বরাদ্দকৃত প্রায় ৮৮ লাখ টাকা কাজ না করিয়েই জুন মাসে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামের যোগসাজশে ইউপি চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্প সভাপতিরা লুটে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে- উপজেলাব্যাপী ১০৯৭ জন শ্রমিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গড় হিসাবে প্রতিটি ইউনিয়নে প্রকল্পের বিপরীতে ২০/৩০ জন শ্রমিক কাগজপত্রে নিয়োগ দেখানো হয়। কিন্তু, বাস্তবে তালিকা বহির্ভূত ১০/১২ জন শ্রমিক দিয়ে ৫/৬টি প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করানো হয়। কিন্তু, প্রতিটি প্রকল্পেই বাস্তবে কোন শ্রমিক কাজ করেননি, কিন্তু ব্যাংক হিসাবে শ্রমিকের নাম ব্যবহার হয়েছে ঠিকই।
তালিকার ২৬নং আশিদ্রোন ইউনিয়নের রামনগর মন্তাজ মিয়ার বাড়ির সামনে হতে মালেক মিয়ার জায়গার পাশ পর্যন্ত পূণঃনির্মাণ প্রকল্পটির কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে রাস্তায় কোন মাটির কাজ হয়নি বলে স্থানীয়রা জানান। এ প্রকল্প ব্যয় ধরা আছে ৪ লাখ টাকা। শ্রমিকের সংখ্যা ২৫ জন। পুরো টাকা পকেটে ভরেছেন সংশ্লিষ্টরা। বাস্তবায়িত তালিকার ৩৬নং জাগছড়া চা বাগানের ৫নং বস্তির রাস্তা নোয়াগাও সীমানা পর্যন্ত পুণঃনির্মান প্রকল্পের কোন অস্তিতই পাওয়া যায়নি। কাজ কোথায় হয়েছে তা স্থানীয়রা বলতে পারেন না। এছাড়াও ১২নং প্রকল্প শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের রুপসপুর মোস্তফা মিয়ার বাড়ির সামনে হতে এবাদ মিয়ার বাড়ির সামনে পর্যন্ত রাস্তা নির্মান, ১০নং প্রকল্প রুপসপুর সবুজবাগ জোড়া পুল হতে সামসুল উদ্দিনের বাসা পর্যন্ত নতুন রাস্তা নির্মান, ৩নং প্রকল্প মির্জাপুর ইউনিয়নের দক্ষিন পাচাউন গ্রামের শফিক মিয়ার জমি হতে হাইল হাওর রাস্তা পূণঃনির্মান, ৩৮নং প্রকল্প সাতগাঁও ইউনিয়নের সাতঁগাও ইছামতি চা বাগান খেলার মাঠের পাশ্ববর্তী রাস্তা পূণঃনির্মান, ৩৪নং প্রকল্প কালিঘাট ইউনিয়নের ভুরভুড়িয়া চা বাগানের শশ্মানঘাটে মাটি ভরাট ও রাস্তা পূণঃনির্মান, ২২নং প্রকল্প কালাপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বরুনা আবু বক্করের বাড়ি হতে মকবুল মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পূণঃনির্মান, ২৩নং প্রকল্প নারায়নছড়া মনাই মিয়ার বাড়ি হতে পশ্চিম জৈনকা নদী পর্যন্ত খাল পূণঃখনন কাজের অস্তিত পাওয়া যায়নি।
এভাবেই কাগজপত্রে ৩৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে সরকারের প্রায় ৮৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যে কয়েকটি প্রকল্পে নামমাত্র কাজ হয়েছে তাতেও ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন প্রকল্প সভাপতিরাও। রাজঘাট ইউনিয়নের ফুসকুঁিড় চা বাগান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট কাজটিতেও অনিয়ম করা হয়েছে। ৫/৭ জন শ্রমিক দিয়ে মাটির কাজ করিয়েছেন প্রকল্প সভাপতি। ব্যবহার করা হয়েছে মাটি কাটার মেশিন। বিদ্যালয়ের প্রবেশমুখের রাস্তার বাম দিকে কিছু মাটি ভরাট করা হলেও, যে পরিমান মাটি ভরাটের কথা সেখানে তা দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ। কালিঘাট ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত ৩৩নং কালিঘাট সাধুবাবুর বাড়ির সামনা হতে শিববাড়ি কালিমন্দির পর্যন্ত রাস্তায় মাটি কাটা প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। সাধুবাবুর বাড়ি সামনা বলা হলের কাজ ধরা হয়েছে একটি ফুট কালভার্ট থেকে। তাও বৃষ্টির দিনে রাস্তার মধ্যখানে মাটি দেয়া হয়। এখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা।
স্থানীয়দের সাথে আলাপ কালে জানা যায়- স্থানীয় মেম্বার রনজিতের মাধ্যমে তার ভাই কাজ করিয়েছেন। মাত্র ৫ দিন কাজ হয়েছে। তালিকাভুক্ত কোন শ্রমিক ছিলনা। তাদের পছন্দের কিছু নারী ও পুরুষ চা শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে ২০০ টাকা হতে ২৫০ টাকা মজুরী দিয়েছেন। রাস্তায় কাজ করা শ্রমিক শিপন রাজভর বলেন- তারা কোন তালিকাভুক্ত শ্রমিক নন। একটি খাতায় হাজিরা দিয়ে টাকা নিতো। ৫ দিন কাজ করেছেন। প্রতিদিন ২৫০ টাকা দেয়া হয়েছে। একই কথা জানান আরেক নারী চা শ্রমিক বর্ষা তাঁতি। কোন রকেট বা বিকাশ একাউন্ট নেই। হাতে হাতে টাকা দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রকল্প সভাপতি জানান- পিআইও এবং চেয়ারম্যানরা যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই কাজ করেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসকে ম্যানেজ করেই টাকা উত্তোলণ করা হয়েছে। তবে, ৫০ ভাগ কাজও হয়নি বলে তাঁরা স্বীকার করেন।
জানতে চাইলে সাতগাঁও ইউপি চেযারম্যান দেবাশীষ দেব রাখু বলেন- একটা কাজে আমি খুবই ব্যস্ত। শহরে দেখা করে কথা বলতেছি। শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম বলেন- একসাথে এতটি কাজ একজনের পক্ষে দেখা সম্ভব না। তারপরও বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করেছি। দেখলাম তারা কাজ করছে, কোনো কোনো এলাকায় চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা কাজের ছবিও দিয়েছেন। কেউ কাজ না করিয়ে বিল উত্তোলণ করতে পারবে না।
শ্রীমঙ্গলের ইউএনও আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বলেন- বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। খোঁজ নিয়ে জানাবো। মৌলভীবাজার জেলা ত্রাণ ও পূর্ণবাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছাদু মিয়া বলেন- প্রকল্পের লিস্টেড শ্রমিকরা কাজ করবে। এর বাইরের কেউ কাজ করার নিয়ম নাই। শ্রমিকদের রকেট একাউন্টে সরাসরি টাকা আসে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- এ প্রক্রিয়ার সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নাই। কাজ আমি দেখতে পারি। তবে টাকা-পয়সার সাথে আমার কোন হাত নাই। সংশ্লিষ্ট ইউএনও এবং পিআইও বিল করে ঢাকা পাঠায়। সেখান থেকে শ্রমিকের রকেট একাউন্টে টাকা ঢুকে। এককথায় এসব ব্যাপারে আমার কোন সম্পর্ক নাই। কাজে অনিয়মের ব্যাপারে খোঁজ নেবো।