রাজনগরে নির্মাণ হলো ৬০ শহীদের স্মৃতিস্মারক ‘বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ’

রাজনগরে নির্মাণ হলো ৬০ শহীদের স্মৃতিস্মারক ‘বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ’

সুরমার ঢেউ সংবাদ :: মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলায় স্বাধীনতার ৫০ বছর পর নির্মাণ হলো গণহত্যায় নিহত ৬০ শহীদের স্মৃতিস্মারক ‘বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ’। দীর্ঘদিনের দাবী পূরণ হওয়ায় খুশি হয়েছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। রাজনগরে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় ’৭১ সালের ১ মে থেকে। স্থানীয় দোসরদের তথ্যের ভিত্তিতে পাক হানাদার বাহিনী রাজনগরের বিভিন্ন স্থানে শুরু করে জ্বালাও পোড়াও লুটপাট ও হত্যাকান্ড। ১ম দিন হানাদাররা রাজনগরের মনসুরনগর ইউনিয়নের পঞ্চেশ্বর গ্রামে নগেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস ও তার ভাতিজা মণি বিশ্বাসকে হত্যা করে। একই দিন মুন্সীবাজারে লুটপাট চালায় এবং গ্রামে প্রবেশ করে সনৎ ঠাকুর, ছায়া শীল, খোকা দেব, মুকুল দাস ও ডা. বনমালী দাসকে হত্যা করে।
১৯৭১ সালের ৭ মে রাতের আঁধারে পাঁচগাঁওয়ে ঘটে যায় ইতিহাসের এক জঘন্যতম গণহত্যার ঘটনা। পাক হানাদাররা প্রায় ৫০ জনের একটি দল দুটি ট্রাকে করে পাঁচগাঁও গ্রামে প্রবেশ করে। স্থানীয় দোসরদের সহযোগিতায় তারা শান্তি কমিটির বৈঠকের কথা বলে গ্রামবাসিকে জড়ো করে সরকার বাজার দীঘির পারে। নিরীহ গ্রামবাসি কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের ধরে ফেলা হয়। দীঘির পাড়ে এনে হাত-পা বেঁধে এক জায়গায় জড়ো করে। গ্রামের ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। একসময় জড়ো করা গ্রামবাসীর শরীর থেকে কাপড় খুলে একজনের গলার সঙ্গে অন্যজনের পা বেঁধে জোড়ায় জোড়ায় দীঘির জলে নিক্ষেপ করে। এরপর ভাসমান লোকদের লক্ষ্য করে চালায় ব্রাশফায়ার। হাত-পা বাঁধা ৬০ গ্রামবাসী সেদিন এখানে শহীদ হন। এ ঘটনায় বেঁচে যান সুবোধ মালাকার ও মীন মালাকার নামে দু’জন। পাক হানাদাররা চলে গেলে স্বজনদের লাশ তুলে এনে দীঘির পশ্চিম পাড়ে একটি গণকবরে মাটিচাপা দেন গ্রামবাসী। পাক সেনাদের ভয়ে সেদিন একটি লাশেরও দাহ করা সম্ভব হয়নি। পাঁচগাঁওয়ের হত্যাযজ্ঞে সেদিন শহীদ হয়েছিলেন তাদের নাম স্মৃতিস্তম্ভে লিখা হয়েছে। তারা হলেন- কৃষ্ণকান্ত চক্রবর্তী, অমূল্য চরণ দাস, হিরন্বয়দাস, কুমুদ নাগসহ ৬০ জন।
দেশ স্বাধীন হবার পর একটি দেয়াল তুলে গণকবরের স্থানটি আলাদা করা হয়েছিল। দীর্ঘদিনের দাবীর প্রেক্ষিতে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর পাঁচগাঁও দীঘির পারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এলাকার ফুল বিবি ও ছায়া রানী মালাকার বলেন- ৭ মে আমাদের বেদনার দিন। এবার একটা সান্ত¦না পেয়েছি। ৫০ বছর পর অবহেলিত গণকবরের পাশে স্মৃতিস্মারক হিসেবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হওয়ায় আমরা খুশি হয়েছি। পাঁচগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধা মোবারক আলীর পুত্র রুবেল আহমদ বলেন- দেরীতে হলেও শহীদদের প্রতি সম্মান দেখানো হয়েছে। স্মৃতিস্মারক হিসেবে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হওয়ায় আমরা খুশি। স্মৃতিস্তম্ভের পাশের বাড়ির শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মনির উদ্দিনের স্ত্রী করোনা বিবি বলেন- স্মৃতিস্মারক হিসেবে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হওয়ায় আমরা খুশি। শরীরে গুলির আঘাতের চিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা সুবোধ মালাকার বলেন- মীন মালাকার আর আমাকে উল্টাউল্টিভাবে বেঁধে দীঘিতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে কচুরীপানার নিচে পড়ে বেঁচে যাই। ৫০ বছর পরে হলেও, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হওয়ায় আমরা খুশি হয়েছি।
জানা গেছে- রাজনগর উপজেলা প্রশাসন জমি সংক্রান্ত জটিলতা মীমাংসা করে দিয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানকাজ বাস্তবায়ন করেছে গণপুর্ত বিভাগ। মৌলভীবাজার গণপুর্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে- ৭০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। কিছু কিছু প্রক্রিয়া এখনো বাকি রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *