পর্ব (১) :: ১৯৪০ দশকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব থেকে সর্বপ্রথম সিলেটে নারী-পুরুষ মিলে জনসমাবেশ, ভাষা আন্দোলনে সিলেটের তরুণ শিক্ষার্থীরা চরমভাবে নির্যাতন বরণ, সিলেট শহরে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ (বর্তমানে শহীদ সুলেমান হল) হলে বার বার সভা সমাবেশের আয়োজন, সিলেট থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীগুলো বাংলাভাষার দাবিতে জনগনের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিকরণ, সিলেটের প্রাণকেন্দ্র গোবিন্দচরণ পার্কে (বর্তমানে হাসান মার্কেট) উত্তাল জনসভা, সিলেটের রাজপথে উত্তাল মিছিল- এভাবে নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে সিলেটবাসী বাংলা ভাষার দাবিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনে রূপান্তরিত করার দুর্দান্ত সাহসী ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালণ করেছেন। ভাষা আন্দোলনের সময় সিলেটের বাইরে, বিশেষ করে ঢাকায় সিলেটের অনেক কৃতিসন্তান উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বিশেষকরে সিলেটের মহীয়সী নারীরা বাংলাভাষা আন্দোলনে ব্যতিক্রমধর্মী অদমনীয় বলিষ্ট সাহসী ভুমিকা রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাংলাভাষা আন্দোলনে সিলেটের এ গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।
জাতির বিভিন্ন সংকটময় সময়ে শাহজালালের পুণ্যভুমি সিলেটের মানুষ বার বার উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।
১৭৮২ সালে ভারত উপমহাদেশে সিলেটের পীরজাদা এবং তার দুই ভাই সৈয়দ মুহাম্মদ হাদি ও সৈয়দ মুহাম্মদ মাহদীর নেতৃত্বে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে উনিশ শতকে সর্বভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন, ১৯৪০ দশকে পাকিস্থান আন্দোলন, ১৯৫০ দশকে বাংলাভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশে বিদেশে বসবাসরত সিলেটবাসীর অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে ইতিহসে লিখা থাকবে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাস, বাংলা ভাষার মাস, আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা উদযাপনের মাস গত হয়েছে কয়েকদিন পূর্বে। বাংলাভাষা আন্দোলনে সিলেটের নারী-পুরুষের কি গৌরবোজ্জ্বল অবদান ছিল, তা আজ দুইপর্বে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। প্রথমপর্বে তুলে ধরবো ভাষা আন্দোলনে সিলেটের নারীদের অবদান এবং দ্বিতীয়পর্বে তুলে ধরবো ভাষা আন্দোলনে সিলেটের পুরুষদের অবদান।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সিলেট ভারতের সাথে থাকবে না প্রস্তাবিত পাকিস্থানে যোগ দেবে এই প্রশ্নের সমাধানের জন্য গণভোটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। উল্লেখ্য- সিলেট তখন আসাম রাজ্যের সাথে সংযুক্ত ছিল।
সিলেটে গণভোটের প্রচারণা চলাকালীন সময়ে মুসলিমলীগের উচ্চ পর্যায়ের একজন নেতা পাকিস্তান সরকারের যানবাহন ও যোগাযোগমন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল সিলেটকে পাকিস্থানে যোগ দেয়ার পক্ষে প্রচারণার জন্য ১৯৪৭ সালের জানুয়ারী মাসে সিলেট সফর করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১১ জানুয়ারী সিলেটের একটি মহিলা প্রতিনিধি দল পাকিস্থানি প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাৎ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরাবরে তাদের কিছু দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি হস্তান্তর করেন। এ স্মারকলিপির দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে হবে বাংলাভাষা। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে স্মারকলিপির মাধ্যমে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন ছিল বাংলাভাষার দাবির ইতিহাসে প্রথম পদক্ষেপ এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বলতর মাইলফলক।
১৯৪০ দশকে সারাদেশে ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠার অনেক আগেই সিলেটের মহিলারা বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষায় রাজপথে নেমে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তখন থেকে সিলেটের মহিলারা ভাষার দাবিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য অনেক ত্যাগ ও নির্যাতন মোকাবেলা করেছেন। তারা সবাই মুসলিমলীগের নেতৃত্ব দানকারী পরিবারের সদস্য এবং তারা নিজেও সবাই মুসলিমলীগের নেত্রী ছিলেন। তা সত্তেও তারা মুসলিমলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে বাংলাভাষার প্রশ্নে কোন প্রকার আপোস করেননি। তারা মুসলিমলীগের ভাষানীতির তীব্র বিরোধীতা ও সমালোচনা করে ভাষা আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে গতিশীল করে তুলেছিলেন।
বাংলাভাষা দাবির পক্ষে সিলেটের নারী-পুরুষের এ আন্দোলন বাধাবিঘ্ন ছাড়া বিনা প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিরোধে এগোয়নি। এ আন্দোলনের জের ধরে সেসময় সিলেটে উর্দু সমর্থক কিছু পথভ্রষ্ট লোক বাংলাভাষার দাবির পক্ষের সভা সমাবেশ ও মিছিলে বাধা দেয় এবং উর্দু সমর্থক পত্রিকা ইস্টার্ণ হেরাল্ড (পরিবর্তিত নাম আসাম হেরাল্ড)-এ মহিলা নেত্রী জোবেদা রহিমের নেতৃত্বে বাংলাভাষার দাবি করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি প্রদানের বিরোধিতা করে একটি সম্পাদকীয়তে অশোভন মন্তব্য প্রকাশ করে। এ অশোভন মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন মহিলা নেত্রী জোবেদা রহিমসহ স্মারকলিপিতে স্বাক্ষরকারী মহিলা নেত্রীরা। মাহমুদ আলী সম্পাদিত সাপ্তাহিক নওবেলালের ১২ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রতিবাদ লিপিতে তিনি বলেন, “যাহারা পুর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী হইয়া মাতৃভাষার বিরুদ্ধাচরণ করে তাহারা মাতৃভাষার বিশ্বাসঘাতক কু-পুত্রতুল্য।”
সিলেটের যে সব মহীয়সী মহিলা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা সবাই ছিলেন উচ্চ বংশদ্ভুত সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক সচেতন পরিবারের সদস্য। তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি হচ্ছে- সে সময়ে সিলেট জেলা মহিলা মুসলিমলীগের সভানেত্রী জোবেদা রহীম- তিনি বাংলাদেশের মহিলাদের রাজনীতির অন্যতম পথিকৃত। তিনি ছিলেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ শিলঘাট নিবাসী খান বাহাদুর শরাফত আলী চৌধুরীর কন্যা, সাবেক আসাম গনপরিষদের সদস্য খান বাহাদুর আবদুর রহিমের স্ত্রী এবং সেসময়ের মন্ত্রীসভার প্রভাবশালী মন্ত্রী তফজ্জুল আলীর শাশুড়ী।
বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী (হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মা)- তিনি ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য। স্বামী আব্দুর রশিদ চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত ভারতের কেন্দ্রীয় বিধান সভার সদস্য।
সহ-সভানেত্রী সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী (অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মা)- তিনি ১৯১৪ সালে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুরের সৈয়দপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে সন্তান। তিনি ছিলেন আসাম পার্লামেন্টে প্রথম মুসলমান মহিলা এমপি। সিলেটের নারী জাগরণের অগ্রদূত, ঐতিহাসিক গণভোট এবং ভাষা আন্দোলনে তার অবদান ছিলো অপরিসীম। তার স্বামী এডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ ছিলেন একজন বলিষ্ঠ আইনজীবি এবং মুসলিমলীগের প্রথম সারির রাজনীতিবিদ।
আরো যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন, সিলেট জেলা মহিলা মুসলিমলীগের সম্পাদিকা সৈয়দা লুৎফুন্নেছা খাতুন, সিলেট সরকারী অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিসেস রাবেয়া খাতুন বিএবিটি, মিসেস জাহানারা মতিন, মিসেস রোকেয়া বেগম, মিসেস শাম্মী কায়সার রশীদ এমএবিটি, নূরজাহান বেগম, মিসেস সুফিয়া খাতুন, মিসেস মাহমুদা খাতুন, মিসেস শামসুন্নেছা খাতুন ও সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন (শেখঘাটের এহিয়া ভিলার গৃহবধূ)।
বাংলাভাষার দাবিতে সিলেটে মহিলাদের অগ্রণী ভূমিকার প্রশংসা করে ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক আবুল কাশেম চিঠি লিখে ভাষা আন্দোলনে সাহসী ভূমিকার জন্যে জোবেদা রহিম চৌধুরীসহ সিলেটের নারী নেত্রীদেরকে অভিনন্দন জানান। তিনি লিখেন, “আজ সত্যিই আমরা অভূতপূর্ব আনন্দ এবং অশেষ গৌরব অনুভব করছি। সিলেটের পুরুষরা যা পারেননি তা আপনারা করেছেন। বাংলাভাষার জন্য আপনারা যে সংগ্রাম করছেন তা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। তমদ্দুন মজলিশ আজ আপনাদের অকৃত্রিম ধন্যবাদ জানাচ্ছে”। উল্লেখ্য- ভাষা আন্দোলনের সময় তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি ছিলেন সিলেটের কৃতি সন্তান জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন সিলেটের আরেক কৃতি সন্তান অধ্যাপক শাহেদ আলী। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন অধ্যাপক শাহেদ আলী।
১৯৪৭ সালের ৮ মার্চের গোবিন্দচরণ পার্কে (বর্তমানে হাসান মার্কেট) ভাষা দাবির জনসভায় উর্দুর পক্ষের লোক ও সরকারী হামলার কারণে সভা করা যায়নি। এ হামলার প্রতিবাদে সিলেটের মহিলারা ১৯৪৭ সালের ১০ মার্চ গোবিন্দচরণ পার্কে একটি সভা আহবান করেন। কিন্তু, এ সভা আয়োজনের পূর্বের রাতে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম. ইসলাম চৌধুরী সমগ্র সিলেটে সভা সমাবেশ আয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি করেন। এতসব বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করে সিলেটর মহিলারা ভাষা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিলেন।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তিনি ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাকে দেয়া সংবর্ধনা সভায় ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার অভিমত পুনর্ব্যক্ত করেন। তখন সিলেটের মহিলারা জিন্নাহকে তারবার্তা পাঠিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো দাবি জানান।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে সিলেটের নারী সমাজ আবারো প্রতিবাদে ফেটে পড়েন এবং ২২ ফেব্রুয়ারী প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা শহীদরের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত মিছিলে সিলেটের মহিলারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশ নিয়ে বেলা ১১টায় শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। মিছিলটি গোবিন্দচরণ পার্কে এসে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তৃতা করেন সিলেটের মহিলা ও ছাত্রী নেত্রীবৃন্দ। পরদিনই মুসলিম সাহিত্য সংসদ হলে (বর্তমানে শহীদ সুলেমান হল) এক মহিলা সমাবেশ করেন এবং বিকালে গোবিন্দচরণ পার্কে সিলেট মহিলা কলেজের ছাত্রী-শিক্ষকদের আয়োজনে কলেজের অধ্যাপক আবদুল মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাভাষার দাবিতে বিরাট জনসভা।
ভাষা আন্দোলনে মহিলাদের মধ্যে সিলেটে আরো যারা ভূমিকা রাখেন তারা হচ্ছেন- বেগম রাবেয়া আলী, ছালেহা বেগম, লুৎফুন্নেছা বেগম, নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদ আলীর স্ত্রী হাজেরা মাহমুদ, সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর স্ত্রী মিসেস রাবেয়া আলী, অধ্যাপক শাহেদ আলীর স্ত্রী বেগম চমন আরা, সরকারি চাকুরে হয়েও স্বামীর মতো ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে তিনিও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। মিসেস লুৎফুন্নেছা বেগমের স্বামী সেনা বিভাগের কর্মকর্তা হওয়া স্বত্ত্বেও তিনি ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
সিলেটের কুলাউড়ার মেয়ে সালেহা বেগম ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী থাকাকালীন ভাষা শহীদদের স্মরণে ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী স্কুলের সামনে কালো পতাকা উত্তোলণ করেন। ছাত্রী সালেহা বেগমের এ সাহসী উদ্যোগকে রাষ্ট্রীয় অপরাধ আখ্যা দিয়ে পাকিস্থান কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ময়মনসিংহের ডিসি ডি কে পাওয়ারের আদেশে স্কুল থেকে তাঁকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। সালেহা বেগমের পক্ষে আর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তিনি হচ্ছেন ভাষা আন্দোলনের ‘শিক্ষাজীবন’ শাহাদতকারী একমাত্র ছাত্রী।
সিলেটের আরেক ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংগঠিত করা ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলের ছাত্রীদের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সুসংগঠিত করেন। ২১ ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম ছাত্রীদলের অন্যতম অদমনীয় নেত্রী ছিলেন রওশন আরা বাচ্চু। তিনি ১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিলেটের কুলাউড়ার উছলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা এএম আরেফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। রওশন আরা বাচ্চু ‘গণতান্ত্রিক প্রোগ্রেসিভ ফ্রন্ট’ এ যোগ দিয়ে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইম্যান স্টুডেন্টস্ রেসিডেন্স এর সদস্য নির্বাচিত হন।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ২০ ফেব্রুয়ারী হরতাল আহ্বান করা হলে সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১৪৪ ধারা জারি করে। এসময় যেসব ছাত্রছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন বলে মনে করেন রওশন আরা বাচ্চু তাদের অগ্রভাগে ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারী সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় আহূত ছাত্র-জনতার সমাবেশে ইডেন কলেজ ও বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থান থেকে ছাত্রীদের সংগঠিত করে সমাবেশস্থলে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যারা কাজ করেছেন রওশন আরা বাচ্চু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম।
রওশন আরা বাচ্চুর সাহসী নেতৃত্বে এখান থেকেই ছাত্রনেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। তারা পুলিশের কাটাতারের ব্যারিকেড টপকে মিছিল নিয়ে এগুনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশের বাধার মুখে কাটাতারের ব্যরিকেড টপকানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ সংকটময় সময়ে বজ্রকণ্ঠে স্বপথ নিয়ে রওশন আরা বাচ্চু তার দলের সবাইকে নিয়ে পুলিশের তৈরি এ অতিক্রমঅসাধ্য ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকেন।। এরপর পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ ও পরে গুলি বর্ষণ শুরু করে দেয়। এতে আব্দুস সালাম, আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমদ, আব্দুল জব্বার ও শফিউর রহমান শাহাদাত বরণ করেন এবং রওশন আরা বাচ্চুসহ অনেক ছাত্রী গুরুতর আহত হন।
সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে একটি স্মৃতিচারণে সিলেটের এ ভাষাসৈনিক নারীনেত্রী রওশন আরা বাচ্চু বলেন, “সকাল দশটার দিকে দেখি একটি জিপ ও ৩/৪টি ট্রাক এসে দাড়ালো এবং পুলিশ বাহিনী ইউনিভার্সিটির গেটটা ঘেরাও করলো। পুলিশ আমাদের মিছিলে লাঠিচার্জ করলো। অনেক মেয়ে আঘাত পেলো, আমিও আঘাত পেয়েছিলাম। আমরা দৌড়ে যাচ্ছিলাম, আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো স্মারকলিপি পৌছে দেয়া। কিন্তু আমাদের পথে মেডিকেলের মোড়েই তখন শেল পড়ছে। চারদিক কাদুনে গ্যাসে অন্ধকার। তখন আবার গুলির শব্দ পেলাম। এরপর তার কাটার বেড়া পার হয়ে ওসমান গনি সাহেবের বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি সারা তৈফুর, সুফিয়া ইব্রাহিম, বোরখা শামসুন। তারা আমার এ রক্তাক্ত অবস্থা দেখে এগিয়ে এল”।
সিলেটের সুনামগঞ্জের অধ্যাপক শাহেদ আলীর সহধর্মীনি বেগম চেমন আরা প্রথমসারির একজন মহিলা ভাষা সৈনিক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী থাকাবস্থায় স্বামী অধ্যাপক শাহেদ আলীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা শহীদ বরকতের রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে যে মিছিল বের করেছিলেন তাতে তিনিও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এভাবে অন্যান্য জেলার তুলনায় সিলেট শহরে এবং ঢাকায় অবস্থানরত সিলেটের নারীরা ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন- যা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল মাইলফলক।
পর্ব (২) :: ১৯৪০ এবং ১৯৫০ দশকে বাংলাভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিরভাবে খ্যাতিমান সিলেটের অনেক বিশিষ্টজন।
রাষ্ট্রচিন্তুক হিসাবে পরিচিত সিলেটের সুনামগঞ্জের মাহমুদ আলী বাংলাভাষা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিলেন। তিনি সভা সমাবেশ করে বাংলাকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করে আসছিলেন। বাংলাভাষার দাবিকে এগিয়ে নিতে এবং কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর নানা দাবির প্রচারের জন্য ‘নওবেলাল’ নামে একটি বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক পত্রিকা চালু করেছিলেন।
ভাষাসৈনিক কমরেড আসদ্দর আলী (সিলেট) এবং ভাষাসৈনিক কমরেড বরুণ রায় (সুনামগঞ্জ) ভাষা আন্দোলনের সময় দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছেন।
জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (সিলেট, সুনামগঞ্জ) সৈয়দ মুজতবা আলী, (সিলেট, মৌলভীবাজার) ও অধ্যাপক শাহেদ আলী (সিলেট, সুনামগঞ্জ) ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রেখেছিলেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং সৈয়দ মুজতবা আলীকে সরকারী কলেজের অধ্যাপনার চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
অধ্যাপক শাহেদ আলী ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সাহিত্য সম্পাদক এবং ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকের সম্পাদক ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের একজন ভাষাসৈনিক হিসেবে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রেখেছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সৈনিক ভাষা আন্দোলনসহ পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত্বশাসন আন্দোলন, শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলন এবং নির্যাতিত মানুষদের দাবীদাওয়ার প্রশ্নে আগাগোড়াই সোচ্চার ছিলেন। সাপ্তাহিক সৈনিক তাদের পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তিরূপী লাহোর প্রস্তাবের মর্মবাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতো, লাহোর প্রস্তাবেই উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। কারণ দেড় হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন একাধিক ভূখন্ড নিয়ে একটি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে প্রায় নেই বললেই চলে।
১৯৪৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আলোচনার জন্য প্রথম বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সিলেট আলীয়া মাদ্রাসা ময়দানে। বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, স্থানীয় আইনজীবী, আমলা এবং প্রখ্যাত লেখক মতিন উদ্দিন আহমেদ এ আলোচনা সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোড়ালো দাবি রেখেছিলেন।
একই বছরের ৩০ আগষ্ট আলীয়া মাদ্রাসা ময়দানে আবার রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একটি বিরাট জনসভা হয়েছিল। এ সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মতিন উদ্দিন আহমদ। এ দুটি সভা পূর্ব পাকিস্তানের যে কোনও জায়গায় রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সভা-সমাবেশের তুলনায় বিরাট এবং প্রথম জনসভা ছিল।
অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সৈয়দ মুজতবা আলী, অধ্যাপক শাহেদ আলী এ তিনজনের সবাই ভাষা আন্দোলনে তাদের অবদানের জন্য একুশে পদকসহ জাতীয় পর্যায়ে উচ্চ সম্মানে ভুষিত হয়েছিলেন।
শিক্ষাবিদ সাহিত্যিক বিশ্বের বিশিষ্ট ১৪টি ভাষায় পারদর্শী খ্যাত সৈয়দ মুজতবা আলী এবং জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ হলে বাংলাভাষার দাবিতে আয়োজিত সভায় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা দাবি করে জোরালো বক্তব্য রেছেছিলেন। তখন সৈয়দ মুজতবা আলী পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা দাবির সংগ্রামে একজন বিশিষ্ট নেতা ও সমর্থক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন অবস্থায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন- যা কলকাতার ত্রৈমাসিক পত্রিকা চতুরঙ্গ এবং সিলেটের মাসিক আল-ইসলাহ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে প্রবন্ধটি পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা শিরোনামে পুস্তিকা আকারে বের হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে পাক সরকারের রোষানলে পড়ে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের পদে ইস্তফা দিয়ে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। বাংলাভাষার দাবিতে আন্দোলনে সৈয়দ মুজতবা আলীর সক্রিয় ভূমিকার জন্য তার কাছে পাকিস্তান সরকার ব্যাখ্যা চেয়েছিল। কিন্তু তিনি এর কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে পদত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদানের জন্য ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক প্রদান করেন। এ ছাড়াও তাঁকে ১৯৪৯ সালে নরসিংহ সাহিত্য পুরষ্কার, ১৯৬১ সালে আনন্দ সাহিত্য পুরষ্কার প্রদান করা হয়। সৈয়দ মুজতবা আলীর গবেষণামূলক ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামের গ্রন্থটির জন্য তিনি বাংলাভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ভাষা আন্দোলনের এক মহান অগ্রদূত। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক, একজন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও সমালোচক। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে তার ভূমিকার জন্য পাকিস্থান সরকার তাঁকে সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে অপমানজনকভাবে বরখাস্ত করেছিল।
পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক, জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদাসহ অনেক সম্মাননা ও পুরষ্কারে ভুষিত হয়েছিলেন। সম্মাননার মধ্যে ছিল- স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮১), ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৮৯), আন্তর্জাতিক মুসলিম সংহতি পুরস্কার (১৯৮৫), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৯১), কবি মোজাম্মেল হক পুরস্কার (১৯৯১), জাতীয় অধ্যাপকরূপে নিযুক্তি (১৯৯৩), মাওলানা আকরাম খাঁ স্বর্ণপদক (১৯৯৩), জালালাবাদ স্বর্ণপদক (১৯৯৪), নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৪), ভাসানী পুরস্কার (১৯৯৫), শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকর পুরস্কার এবং স্বপ্নাবেশ পুরস্কার প্রভৃতি।
অধ্যাপক শাহেদ আলী (সুনামগঞ্জ সিলেট)- তিনি ছিলেন সক্রিয় প্রথম কাতারের একজন ভাষাসৈনিক। তিনি সার্বক্ষণিক ভাষা আন্দোলনের কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগঠক, সংস্কৃতিসেবী ও রাজনীতিক। তিনি ভাষা আন্দোলনের অগ্রদূত সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৪০-১৯৫০ দশকে চলমান ভাষা আন্দোলনের সময় অধ্যাপক শাহেদ আলী বিভিন্ন বুদ্ধীবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করেছেন। ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামে বাংলাভাষার দাবিতে প্রথম পুস্তক তিনিই সম্পাদনা করেছিলেন। বাংলাভাষা উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ঢাকার মিরপুর বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মিরপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার পর তিনি মীরপুর বাংলা কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন।
তিনি বেশ ক’টি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৪৪-৪৬ সালে মাসিক প্রভাতী, ১৯৪৮-৫০ সালে সাপ্তাহিক সৈনিক, ১৯৫৫ সালে দৈনিক বুনিয়াদ, ১৯৫৬ সালে দৈনিক মিল্লাতের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে বাংলা একাডেমী পত্রিকার সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন।
অধ্যাপক শাহেদ আলী ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮১ সালে ভাষা আন্দোলন পদক, ১৯৮৯ সালে একুশে পদক, ১৯৮৬ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ পুরস্কার, কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর ২০০৩), কবি ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, জাসাস স্বর্ণপদক, তমদ্দুন মজলিস, মাতৃভাষা পদক (২০০০) এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে সুনামগঞ্জ থেকে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
মহান ভাষা আন্দোলনে ভাষাসৈনিক শিক্ষাবিদ মুসলিম চৌধুরীর রয়েছে অসামান্য অবদান। তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সর্বপ্রথম প্রবন্ধ রচনা করেন। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সাধারণ সভায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামের এ প্রবন্ধটি তিনি উপস্থাপন করেন। সফল সংগঠক মুসলিম চৌধুরী ১৯৭০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকাস্থ জালালাবাদ এসোসিয়েশন তাকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করে।
ড. আখলাকুর রহমান (সুনামগঞ্জ) ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক। একটি দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি গঠনে মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরে যেসব অভিমত তিনি রেখেছেন, তা আজো প্রণিধানযোগ্য।
১৯৪৭ সালে জানুয়ারী মাসে সিলেটে সফররত পাকিস্থানি প্রতিনিধি দলের সাথে একটি যুব-প্রতিনিধি দল সাক্ষাত করে বাংলাভাষার দাবিতে একটি স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। তাদেরকে সিলেটবাসী এখনও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। গত ২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী সিলেট সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য সিলেটের ভাষাসংগ্রামীদের সম্মাননা দেয়া হয়েছে। সিলেটের হোটেল স্টার প্যাসিফিকের গ্র্যান্ড সেলিব্রেটি হলে এ সম্মাননা প্রদান সভায় যাদেরকে সম্মামনা দেয়া হয় তাঁরা হচ্ছেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান (মরণোত্তর), সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ (মরণোত্তর), শিক্ষাবিদ ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী (মরণোত্তর), এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ (মরণোত্তর), কমরেড আসদ্দর আলী (মরণোত্তর) ও ডা. মো. হারিছ উদ্দিন (মরণোত্তর)।
সিলেটের যেসব কৃতি সন্তান সিলেটের বাইরে, বিশেষ করে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক’জন হচ্ছেন, সৈয়দ শাহাদত হোসেন, তাসুদ্দুক আহমদ, ড. আখলাক হোসেন প্রমুখ।
ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য সিলেটের তিন বাড়ী নামে খ্যাত সিলেট শহরের নয়া সড়কের কালাবারী, চারাদিঘিপারের ধলাবারী, রায় নগরের লালবারী এ তিনজনের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।
সিলেটে ভাষা আন্দোলনে বিশিষ্টজন আরো যারা সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে আহমদ কবির চৌধুরী ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষন শুরু করলে ভাষাসৈনিক জোবেদা রহিমের পুত্র আহমদ কবির চৌধুরী মারাত্মকভাবে আহত হন।
সিলেটের আরো যারা ভাষা আন্দোলনে অবদান রেখেছেন তারা হচ্ছেন- আবদুল আজিজ, আবু জাফর আবদুল্লাহ, আবদুর রহিম, আবুল বশর, আবদুল মজিদ, আবু নছর মনির বখত মজুমদার, আবদুল হক, আবদুল হাই, আবদুল হামিদ, আবদুল মালিক, আবুল হাসনাত সাদত খান, উবেদ জায়গীরদার, এনামুল হক, ওয়ারিছ আলী, খন্দকার রুহুল কুদ্দুস, জালাল উদ্দিন আহমেদ খান, তারা মিয়া, তসদ্দুক আহমদ, দেওয়ান আহমদ কবির চৌধুরী, দেওয়ান ফরিদ গাজী, কবি দিলওয়ার, দবির উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, নাইয়ার উদ্দিন আহমদ, নূরুল ইসলাম, নূরুল হক, নূরুর রহমান, নির্মল চৌধুরী, পীর হাবিবুর রহমান, প্রসূনকান্তি রায়, ফখরুদ দৌলা, ফারুক আহমদ চৌধুরী, বাহাউদ্দিন আহমদ, মকসুদ আহমদ, মতছির আলী, মতিন উদ্দিন আহমদ, মনির উদ্দিন আহমদ, মনির উদ্দিন, মহিবুর রহমান, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, রিয়াছদ আলী, রাবেয়া খাতুন, লিয়াকত আলী, শরফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী, শাহেদ আলী, সখাওতুল আম্বিয়া, সাফাত আহমদ চৌধুরী, সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন, সৈয়দ মোতাহির আলী, সোনাওর আলী, সিরাজউদ্দিন আহমদ ও শামসুদ্দিন আহমদ। সমাপ্ত