সুরমার ঢেউ সংবাদ :: ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) আওতায় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন কার্যক্রমের শুরুতেই প্রায় দুই লাখ ‘ভূতুড়ে’ সুবিধাভোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে দেড় লাখ অবৈধ পেনশনভোগীর হিসাব ব্লক (বন্ধ) করা হয়েছে। বন্ধের প্রক্রিয়ায় আছে আরও ৫০ হাজার হিসাব। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, পেনশনভোগীরা মারা যাওয়ার পরও তাদের নামে যে হিসাব ছিল, সেখানে বছরের পর বছর সরকারি অর্থ জমা পড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন শাখার সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় একটি জালিয়াত চক্র। কারণ ওই সময় অ্যানালগ পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অর্থ দেওয়াসহ পেনশনের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হতো। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে ওই চক্রটি। কখন থেকে এবং কী পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছে, তা এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তবে প্রাথমিক হিসাবে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) প্রায় ২৪০০ কোটি টাকা ওই চক্রের পকেটে গেছে।
আজ সোমবার ইএফটির মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন কার্যক্রম সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে অবহিত করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত পেনশনারদের সুবিধা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হবে সেখানে। এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে।
সরকারি পেনশন অ্যান্ড ফান্ড ম্যানেজমেন্ট ইউটিনের প্রধান হিসাব (অর্থ) কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোমিনুল হক ভুঁইয়া বলেন, প্রকৃত পেনশনভোগী খুঁজে পাওয়া যায়নি বা মারা গেছেন-এমন দেড় লাখ হিসাব ইতোমধ্যে ব্লক করা হয়েছে। এসব হিসাবের বিপরীতে ভবিষ্যতে কোনো টাকা দেওয়া হবে না। কারণ তাদের হিসাবের বিপরীতে কোনো সুবিধাভোগীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, আরও ৫০ হাজারের বেশি ভূতুড়ে পেনশনভোগীর অস্তিত্ব পাওয়া যেতে পারে। তবে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শতভাগ পেনশন কার্যক্রম ইএফটির আওতায় আনা হবে। এরপর হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে কোনো পেনশনারকে চেক বা অ্যাডভাইসের মাধ্যমে অর্থ দেওয়া হবে না-এমন নির্দেশনা সংশ্লিষ্টদের দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, প্রতিবছর একবার পেনশনভোগীকে নিজে হিসাবরক্ষণ অফিসে হাজিরা দিতে হবে। এতে নিশ্চিত হওয়া যাবে পেনশনভোগী জীবিত থাকার বিষয়টি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে এটি শনাক্ত হয়েছে, তা ইতিবাচক ও প্রত্যাশিত। যে উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছে, বিশেষ করে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ, সেটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। দুই লাখ ভূতুড়ে পেনশন ধরা পড়েছে-এই তথ্য যথেষ্ট নয়। আমার ধারণা, সরকার এ বিষয়ে একটু তৎপর হলে এই সুবিধা হাতিয়ে নেওয়া ব্যক্তিদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত।
পেনশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ইউনিট সূত্র জানায়, বর্তমান ‘আইবাস প্লাস প্লাস’ নামে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে মোট পেনশনার চিহ্নিত হয়েছে ৮ লাখ ৯০ হাজার। এর মধ্যে রেলওয়ের পেনশনভোগী হচ্ছে ৪৫ হাজার, ডিফেন্সের ১ লাখ ৭৫ হাজার এবং বাকি ৬ লাখ ৭০ হাজার হচ্ছে বেসামরিক পেনশনার। তবে রেলওয়ে এবং ডিফেন্সের পেনশন ব্যবস্থার হিসাব পৃথকভাবে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। রেলওয়ের পেনশন দেওয়া হচ্ছে নগদ বা চেকের মাধ্যমে। এটি রেল মন্ত্রণালয় হিসাব সংরক্ষণ করছে।
জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে পেনশন কার্যক্রম অনলাইনে বা ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই প্রক্রিয়া হিসাবে ২০১৯ সালে জুলাই থেকে ‘আইবাস প্লাস প্লাস’ নামে একটি সফটওয়্যার চালু করা হয়। এই পদ্ধতি শুরুর আগে আগে অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ২০ হাজার। কিন্তু সফটওয়্যার চালুর পর প্রকৃত পেনশনভোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭০ হাজারে। অর্থাৎ, ভূতুড়ে পেনশনার পাওয়া গেছে ১ লাখ ৫০ হাজার।
সংশ্লিষ্টদের মতে, অ্যানালগ পদ্ধতিতে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মৃত্যুর পরও তাদের নামে বছরের পর বছর টাকা তোলা হতো। ব্যাংকগুলো প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের এই টাকা পরিশোধ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি করত। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে তাদের দাবি অনুযায়ী অর্থছাড় করে আসছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিবছর রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতচক্রের পকেটে যেত। কিন্তু ‘আইবাস প্লাস প্লাস’ চালু হওয়ার পর প্রত্যেক পেনশনারকে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিয়েই লিপিবদ্ধ এবং নিজস্ব ব্যাংক হিসাব খুলে টাকা দেওয়ার পদ্ধতি শুরু হয়। এরপরই চিহ্নিত হয় ভূতুড়ে পেনশনভোগী।
সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উপজেলার শাখা থেকেই বেশির ভাগ পেনশনার টাকা উত্তোলন করেন। আর সরকারের তরফ থেকে ধরে নেওয়া হয়, ওই ব্যাংকের কর্মকর্তারা উপজেলার সব পেনশন সুবিধাভোগীকে চেনেন। কেউ যদি ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে পেনশন তুলতে যান আর ব্যাংক কর্মকর্তারা তাকে চেনার পরও অর্থ দেন, সেক্ষেত্রে ওই কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভুয়া পেনশনারের যোগসাজশ থাকে। ফলে এদের শনাক্ত করাও কঠিন হয়। এভাবে এই জালিয়াতির ঘটনাগুলো বছরের পর বছর ঘটেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিভিল, ডিফেন্স ও রেলওয়ের মোট ৮ লাখ ৯০ হাজার পেনশনারের মধ্যে ইএফটির আওতায় আনা হয়েছে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩৫ জনকে। এর মধ্যে বেসামরিক ৬ লাখ ৭০ হাজার পেনশনভোগীর মধ্যে ইএফটির আওতায় এসেছে ৪ লাখ ৭১ হাজার জন। আরও ১ লাখ ৯৯ হাজার পেনশনভোগীর হিসাব ইএফটির বাইরে আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে এসব পেনশনভোগীর তথ্য চাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা-এখান থেকেও ৫০ হাজারের বেশি ভূতুড়ে পেনশনভোগী শনাক্ত হবে।
এছাড়া রেলওয়ের ৪৫ হাজার পেনশনভোগীর মধ্যে ইএফটির আওতায় আসছে ২২ হাজার ৮৮৬ জন এবং ডিফেন্সের ১ লাখ ৭৫ হাজার পেনশনভোগীর মধ্যে আসছে ৪১ হাজার ৫৬৩ জন। এসব পেনশনভোগীর নিজস্ব ব্যাংক হিসাব রয়েছে। পেনশনের টাকা সরাসরি ব্যাংক হিসাবে যাচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পেনশন বাবদ অর্থছাড় করা হয়েছে ১০ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরে এ খাতে (আনুতোষিকসহ) ব্যয় হয়েছে ১৬ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। সূত্র: যুগান্তর