সুরমার ঢেউ সংবাদ :: মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বঙ্গবীর জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর ৩৭তম মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয়েছে আজ ১৬ ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার। ১৯৮৪ সালের এইদিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় এম.এ.জি ওসমানীর কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, বাদ জোহর মরহুমের গ্রামের বাড়িতে বঙ্গবীর ওসমানী ট্রাস্ট এর উদ্যোগে মিলাদ মাহফিল, সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত হযরত শাহজালাল (রহ:) মাজার প্রাঙ্গণে খতমে কোরআন এবং বাদ আছর হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার মসজিদে মিলাদ শেষে মরহুমের মাজার জিয়ারতসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছিল।
এছাড়াও, মৃত্যুবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালনের লক্ষ্যে “বঙ্গবীর ওসমানী স্মৃতি সংসদ সিলেটের পক্ষ থেকে ২ দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ১ম দিন গতকাল ১৫ ফেব্রুয়ারী সোমবার নাইওরপুলস্থ ওসমানী যাদুঘরে শিক্ষিত বেকার মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের মধ্যে সেলাই মেশিন বিতরণ এবং গরীব মেধাবী (৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণি) শিক্ষার্থী যারা আর্থিক সঙ্কটের কারণে ভর্তি হতে পারেনি তাদের মধ্যে নগদ টাকা ও শিক্ষা উপকরণাদি বিতরণ করা হয়।
বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী বৃহত্তর সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর পিতার কর্মস্থল সুনামগঞ্জে ১৯১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসাবে সরকারী বিভিন্ন উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর মাতা মরহুমা জুবেদা খাতুন একজন ধার্মিক রমণী ছিলেন।
শৈশবে ওসমানী “আতা” নামে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই ওসমানী লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলেন। পিতামাতার নিরলস অনুশাসন এবং যোগ্য গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ওসমানী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর তিনি গৌহাটির কটনস স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। তিনি সিলেট গভর্ণমেন্ট হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন এবং ইংরেজীতে কৃতিত্বের জন্য “প্রিটোরিয়া অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ১৯৩৪ সনে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ছাত্র হিসাবে সবসময়ই ওসমানী অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন।
ওসমানী ১৯৩৯ সনের জুলাই মাসে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৪০ সনের ৫ অক্টোবর ব্রিটিশ আর্মির সর্বকনিষ্ঠ মেজর পদে উত্তীর্ণ হন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি একটি ব্যাটিলিয়ানের অধিনায়ক হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। সৈনিক জীবনের দীর্ঘ পরিসরে বঙ্গবীর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়েছেন। ওসমানী পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্ণেল পদে কর্মরত থাকাকালীন একজন স্বাধীনচেতা বাঙালি সেনা কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। অত্যন্ত দূরদর্শী সেনা কর্মকর্তা হিসাবে বাঙালি সেনাদের স্বার্থে পাকিস্তানীদের সঙ্গে দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ পুনর্গঠন করে ২ থেকে ৬ ব্যাটালিয়ানে উন্নীত করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অধিক হারে বাঙালিদের নিয়োগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন। এজন্য বাঙালি সেনারা তাকে পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা করেন এবং তাঁকে ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জনক, হিসাবে সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল এর দায়িত্বে নিয়োজিত থাকাকালে ইপিআরএ পাকিস্তানি সেনাদের নিয়োগ বন্ধ রাখেন। বাঙালি সেনাদের স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি নিজের পদন্নোতির তোয়াক্কা করেননি। বাঙালিদের প্রতি ওসমানীর এ সমস্ত ত্যাগ এবং নিঃস্বার্থ অবদানসমূহ বঙ্গবন্ধুর বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওসমানী ১৯৬৭ সনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কর্ণেল পদে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে গণ অভ্যুত্থানের সময় ওসমানী বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত সকল অফিসার এবং জোয়ানদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করার জন্য আহ্বান জানান। তারই ডাকে সাড়া দিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সকল কর্মকর্তা সেনাসদস্য তার সঙ্গে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করায় তাদের নেতৃত্বে সাড়া দিয়ে দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ আওয়ামীলীগের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে যোগদান করেন। এসমস্ত সেনা সদস্যদের সুযোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ পরিচালনায় দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে লাখো লাখো মানুষের শাহাদাতের বিনিময়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে।
১০ এপ্রিল ১৯৭১ সনে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হবার পর ১২ এপ্রিল ১৯৭১ সন হতে বঙ্গবীর ওসমানীকে মুক্তিবাহিনী গঠন করা ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রীর সমমর্যাদায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীসহ মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবীর ওসমানীকে ১৯৭১ সনের ১৬ই ডিসেম্বর কর্ণেল পদ হতে জেনারেল পদে উন্নীত করেন।