মশাকে পৃথিবীর সর্বত্র দেখা যায়। এমনকি হিমালয়ের ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় অথবা খনিগর্ভে ৪০০০ ফুট গভীরেও মশা রয়েছে। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩২০০ প্রজাতির মশা দেখা যায়। তবে আমাদের দেশে রয়েছে ২০০ প্রজাতির মশা। আবার ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ১২ ধরনের মশা দেখা যায়। এদের মধ্যে কেবল এডিস, অ্যানোফিলিস ও কিউলেক্স প্রজাতির মশা রোগ সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের এখানে মশাঘটিত যেসব রোগ দেখা যায়, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, জাপানি এনকেফালাইটিস, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া ও পীতজ্বর।
একটা কথা জানা দরকার, মশাদের মধ্যে কেবল স্ত্রী মশারাই রোগ সৃষ্টি করতে পারে। পুরুষ মশা কোন রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। এরা সাধারণত ঝোপঝাড়ের মধ্যে থাকে। এদের শৃঙ্গ একটু ভোঁতা ধরনের। এরা বিভিন্ন গাছের পাতার রস খেয়ে বেঁচে থাকে। সন্ধ্যার সময়টা হলো মশাদের মিলনের সময়। এ সময় মশাদের গুনগুন আওয়াজ আমাদের অতিষ্ট করে তোলে। একটি স্ত্রী মশাকে ঘিরে অনেকগুলো পুরুষ মশা তার চারদিকে ঘুরতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে পুরুষ মশাদের মধ্যে এ সময় একটা প্রতিযোগিতা চলতে থাকে কে স্ত্রী মশাকে জয় করতে পারে। এ সময় স্ত্রী মশারা ডানায় এক শব্দ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের জয় করতে পুরুষদের আহবান জানায়। স্ত্রীর সঙ্গে কোন একটি পুরুষ মশার মিলন হলে স্ত্রী মশাটি আর কোন পুরুষকে তার ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয় না। পুরুষ মশাটির এতটুকু ভূমিকা, তারপর মৃত্যুর পালা। এরা দিন সাতেকের মতো বাঁচে।
বিভিন্ন মশা রাতের বিভিন্ন সময় কামড় দেয়। এডিস মশা দিনের বেলা ১০-১২ টার মধ্যে এবং বিকেল বেলা ৪-৬ টার মধ্যে কামড়াতে ভালবাসে। এরা আবার একসঙ্গে ৪-৫ জনকে কামড়ায়। তবে কিউলেক্স মশা সারাদিন রাত কামড় দেয়। অ্যানোফিলিস মশারা বিভিন্ন সময় কামড়ায়। একটা হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি ২০০টি মশার মধ্যে অ্যানেফিলিসের সংখ্যা মাত্র ২-৩টি, এডিস মশা ৫-৬টি, বাকি সব কিউলেক্স। মুটামুটিভাবে বলা যায়, অ্যানোফিলিস, এডিস ও কিউলেক্স মশার কামড়ের অনুপাত ১:৩:২০।
রক্ত খাবার সময় স্ত্রী মশারা প্রথমে কিছুটা রস (অ্যান্টি-কোয়াগুলেন্ট) মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়, যাতে রক্ত জমাট বাঁধতে না পারে। দেহের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া রসের মাধ্যমে রোগবাহক মশাগুলো মানুষের মধ্যে বিভিন্ন রোগ জীবাণু ছড়িয়ে দেয়। জীবন নেয়ার ক্ষেত্রে অ্যানোফিলিস বা কিউলেক্সের চেয়ে এসিড এগিয়ে। ডেঙ্গু বা চিকনগুনিয়া রোগের বাহক (ফ্ল্যাবি ভাইরাস ও আলফা ভাইরাস)।
ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত মানুষের রক্তে থাকা অনুচক্রিকার পরিমাণ সাংঘাতিকভাবে কমে যায়। ডেঙ্গুর ভাইরাস (ফ্ল্যাবি ভাইরাস) চার ধরনের হয়। যেমন ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩, ডেন-৪। একবার কোন ব্যক্তি ডেন-১ দ্বারা আক্রান্ত হলে পরে আর নতুন করে এটা দিয়ে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ এর মধ্যেই ব্যক্তির দেহে ডেন-১ প্রতিরোধী অ্যান্টি-বডি (আইজিএম) স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠে। জ্বর দেখে ডেঙ্গু চেনা যায়। ডেঙ্গুতে টানা ৫-৭ দিন জ্বর থাকে ও চিকনগুনিয়া রোগে একটানা ৩ দিন জ্বর হবার পর পুরোপুরি জ্বর কমে যায়। আবার ৩ দিন পর জ্বর হতে পারে। যেহেতু ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস দু’টো টোগা ভাইরাস গ্রুপের তাই উভয় রোগের চিকিৎসা পদ্বতিও প্রায় এক রকম।
মশার শুঙ্গ দু’টি দেখে স্ত্রী ও পুরুষ চেনা যায়। পুরুষ মশার শুঙ্গ ঘন লোমে ঢাকা আর স্ত্রীদের ক্ষেত্রে পাতলা লোম। আবার গায়ের রং, ডানা ও তিন জোড়া পাখনা দেখে মশা চেনা যায়। অ্যানোফিলিস মশার গায়ের রং ধূসর-বাদামি, এদের সাদা ডানায় ৩-৪টি কালো ছোপ দাগ থাকে। এদের ওড়ার শব্দ প্রায় শোনা যায় না। মশাদের মধ্যে কেউলেক্স খুবই সাদাসিধে।
মশা নিবারণে বর্তমান ম্যাট, কয়েল-লিকুইড এসব ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এসব রাসায়নিক হলো পাইরোথ্রাস নির্যাস থেকে কৃত্রিম উপায়ে পাওয়া ‘আলিথ্রিন’। সাধারণত কাগজের মন্ডের সঙ্গে দুই শতাংশ অ্যালিথ্রিন মিশিয়ে ম্যাট তৈরি করা হয়। লিকুইডগুলো বিদ্যুতের সাহায্যে উত্তপ্ত করে বাষ্পকে সারা ঘরে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এ বাস্পে মশার স্নায়ুতন্ত্র অবশ হয়ে পড়ে ফলে মশা মরে যায় অথবা পালিয়ে যায়। অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সে’র বক্তব্য, লাগাতার ম্যাট, কয়েল ব্যবহারে মানুষের অ্যালার্জি, গলা ও শ্বাসনালীর বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে এটা সত্য যে, হাঁপানি রোগীদের কাছে এ অ্যালিথ্রিনের বাষ্প মারাত্মক কষ্টদায়ক হিসেবে কাজ করে। আবার ধূপের ধোঁয়া শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি বিপদজনক। অনেকে মনে করেন, এতে বাচ্চাদের স্নায়ুতন্ত্র কিছুটা হলেও অবশ হয়ে পড়ে।
তাই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে ম্যাট বা কয়েল জ্বালিয়ে প্রায় আধ ঘন্টা রাখার পর খুলে দিলে মশা ও ধোঁয়া দুটিই বেরিয়ে যায়। এতে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমে। দেখা গেছে, মশা মারার জন্য দিনের পর দিন যতই বিভিন্ন ধরনের ঔষধপত্র আবিষ্কৃত হচ্ছে মশারাও প্রাকৃতিক নিয়মে বিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন ঔষধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলছে।
মশার ভয়ে ভীতু মানুষদের জন্য একটা সুখবর আছে। বর্তমানে জীনতত্তে্বর মাধ্যমে পুরুষ মশাগুলোকে বন্ধ্যা করা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় গামারশ্মি প্রয়োগ করে বা থিয়োটেপা নামক রাসায়নিক পদার্থের সাহায্যে মশার ক্রোমোজোমের গঠনের পরিবর্তন করে তাকে নির্জীব করা সম্ভব হয়েছে।
বাস্তবে দেখা যায়, মানুষের বড় শত্রু মানুষই। কোন একটা প্রজাতির জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো সে প্রজাতির জীব। সুতরাং অনুমান করা যায়, মশার শত্রু মশাই হতে পারে। এ যেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। তাই মশা দিয়ে মশাকে ধ্বংস করা গেলে সেটা হবে সবচেয়ে সহজ পথ।
আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।